আমাদের বিভিন্ন শারীরিক এবং মানষিক কার্যক্রম সংগঠিত হওয়ার পেছনে যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পাল করে এবং কাজ করে ,সেটাকে বলা হয় হরমোন । হরমোন হলো এক প্রকারের সংকেত অনু (সিগনালিং মলিকিউল) ,যা আমাদের শরীরে বিভিন্ন গ্ল্যান্ড এর মাধ্যমে তৈরী হয় । পরবর্তীতে আমাদের সংবহন তন্ত্র (সার্কিউইলেটরি সিস্টেম) এর মধ্যে দিয়ে রক্তের মাধ্যমে শরীরের অংগ প্রত্যংগের মধ্যে পৌছায় ।আর এর ফলে আমাদের বিভিন্ন শারীরিক ,মানসিক অবস্থা এবং ব্যাবহার কে হরমোন পরিচালনা এবং নিয়ন্ত্রন করে।
আমাদের শরীরে অনেক ধরনের হরমোন তৈরী হয় , চলো প্রাথমিক নারী লৈঙ্গিক হরমোনগুলো (ফিম্যাল সেক্স হরমোন) নিয়ে কিছু তথ্য জেনে নেই ।
ফিম্যাল সেক্স হরমোন প্রধানত নারীদের প্রজনন তন্ত্র এবং ব্যাবস্থার (ফিম্যাল রিপ্রডক্টিভ সিস্টেম) মাধ্যমে আমাদের শরীরে তৈরী হয় । মেয়েদের শরীরে প্রধানত দুই ধরনের লৈঙ্গিক হরমোন বা সেক্স হরমোন তৈরী হয়, এগুলো হলো ইস্ট্রোজেন ( Estrogen) এবং প্রজেস্টেরন (Progesterone)।
এই দুই ধরনের হরমোন ছাড়াও মেয়েদের শরীরে আরেক ধরনের হরমোন কিছু পরিমানে তৈরী হয় আর সেটাকে টেস্টোস্টেরন (testosterone ) বলে । যদিও টেস্টোস্টেরন ছেলেদের হরমোন (Testosterone – male hormone) , তবে মহিলা প্রজনন তন্ত্র ( ফিম্যাল রিপ্রডাক্টিভ সিস্টেম) অল্প পরিমানে এই টেস্টোস্টেরন (testosterone) নামক ছেলেদের সেক্স হরমোন (মেইল সেক্স হরমোন) তৈরী করে থাকে ।
এবার চলো জেনে নিই মহিলা প্রজনন তন্ত্র ( ফিম্যাল রিপ্রডক্টিভ সিস্টেমের) যেসব প্রাথমিক লৈঙ্গিক হরমোন (ফিম্যাল সেক্স হরমোন) তৈরী করে ,সেসব হরমোন এর কাজ কি এবং কিভাবে আমাদের শরীরের অনেক কাজ কে নিয়ন্ত্রন এবং পরিচালনা করে থাকে ।
১) ইস্ট্রোজেন :
ইস্ট্রোজেন হলো প্রধান লৈঙ্গিক হরমোন (ফিম্যাল সেক্স হরমোন)। বেশির ভাগ এস্ট্রোজেন তৈরী হয় অভারিতে (ovary) এবং কিছু পরিমানে তৈরী হয় অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি এবং ফ্যাট কোষ (Adrenal glands and fat cells)। এবং গর্ভাবস্থায় প্লাসেন্টাও (placenta) কিছু পরিমানে ইস্ট্রোজেন তৈরী করে থাকে।
ইস্ট্রোজেন প্রধানত প্রজনন ও যৌন বিকাশে গুরুত্ত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে থাকে। চারটি ক্ষেত্রে এই হরমোন কাজ করেঃ
১) বয়ঃসন্ধিকাল (Puberty)
২) মাসিক (Menstruation)
৩) গর্ভাবস্থা (Pregnancy)
৪) মাসিক বন্ধের সময় বা পরে (Menopause)
এবার আসো একটু বিস্তারিত জেনে নিই এই ইস্ট্রোজেন এবং এবং প্রজেস্টেরনের কাজ কি ।ইস্ট্রোজেন হচ্ছে এক প্রকারের লৈঙ্গিক হরমোন বা সেক্স হরমোন যা নারীদের গঠনগত ,শারীরিক এবং মানষিক বৈশিষ্ট্য (female characteristics) কে বজায় রাখে এবং বিকাশ করে। তার মানে হলো এই লৈঙ্গিক হরমোন বা সেক্স হরমোন একজন নারীর বৈশিষ্ট্য ,ব্যাবহার এবং স্বভাবকে তৈরী করে এবং পরিচালনা করে ।
এছাড়াএ ইস্ট্রোজেন মহিলাদের যৌন বৈশিষ্ট্যগুলোর (female secondary sexual characteristics) বৃদ্ধি এবং উন্নয়নে গুরুত্ত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে । যেমন স্তন, পিউবলক এড়িয়াতে এবং বগলে চুল গজানো, মাসিক চক্র এবং প্রজনন সিস্টেমের নিয়ন্ত্রণ করে।
আর এই ইস্ট্রোজেন এর কারনেই নারী পুরুষের অনেক শারীরিক এবং মানসিক পার্থক্য দেখা যায়।
উদাহরন সরূপ বলা যেতে পারে , ইস্ট্রোজেন এর কারনে অনেক নারীরা পুরুষের চেয়ে উচ্চস্বরে কথা বলতে পারেন। সাধারনত আমাদের প্রজনন অংগ-প্রত্যংগ এই ইস্ট্রোজেন তৈরী করে থাকে । এ ছাড়াও গবেষনাগারে কৃত্তিম উপায়ে ইস্ট্রোজেন তৈরা করা হয়ে থাকে ,যা জন্মনিরোধক বড়ি (ফিম্যাল বার্থ কন্ট্রোল পিলে) হিসেবে ব্যাবহার করা হয়ে থাকে।
ডিম্বানুতে যে ফলিকল থাকে ,সেটাকে বৃদ্বি এবং পরিনত করার জন্য ইস্ট্রোজেন গুরুত্ত্বপূর্ন ভুমিকা পালন করে।
বয়সন্ধিকাল থেকে ইস্ট্রোজেন আমাদের ভেজাইনাকে(যোনী) পরিনত আকার এবং আকৃতি দিতে সাহায্য করে, এছাড়াও ভেজাইনার এসিডকে (vaginal acidity) বাড়িয়ে দেয় যা আমাদের ভেজাইনাকে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ (bacterial infections) থেকে রক্ষা করে।
ইস্ট্রোজেন ইউটেরাসের পেশী কে বৃদ্ধি করে এবং সংকোচন (কন্ট্রাকশন) তৈরী করে । এবং একজন মা যখন প্রাকৃতিক উপায়ে সন্তান জন্মদান করে থাকেন ,তখন এই সংকোচন
খুবই গুরুত্ত্বপূর্ন ভুমিকা পালন করে।
ইস্ট্রোজেন পুরুষের শুক্রানুকে (স্পার্ম) নারীর ডিম্বানুর কোষে (এগ ছেল ) পৌছাতে সাহায্য করে এবং নিষেকে (ফার্টিলাইজেশন) সাহায্য করে, যা পরবর্তীতে গর্ভধারন এবং সন্তাম জন্মদান করে।
এছাড়াও ইস্ট্রোজেন বয়সন্ধিকাল থেকে ব্রেস্টকে পরিনত করে , এবং একজন মা যখন সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করে দেন ( ব্রেস্ট ফিডিং) ,তখন দুধের প্রবাহ (মিল্ক ফ্লো) বন্ধ করে দেয় ।এছাড়াও ইস্ট্রোজেন ব্রেইন , হৃদপিন্ড ,মাংসপেশী , মূত্রনালীর এবং চামড়ার অনেকে কাজ সম্পাদনে সাহায্য করে ।
ইস্ট্রোজেনের প্রভাব রয়েছে এমন অন্যান্য ক্ষেত্রগুলির মধ্যে রয়েছে:
মস্তিষ্ক: এটি শরীরের তাপমাত্রা বজায় রাখতে, যৌন বিকাশের সাথে যুক্ত মস্তিষ্কের অংশকে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং মস্তিষ্কের “ভালো-অনুভূতি” রাসায়নিকগুলির প্রভাব বাড়াতে সহায়তা করে।
ত্বক: ইস্ট্রোজেনগুলি ত্বকের পুরুত্ব এবং গুণমানের পাশাপাশি কোলাজেনের সামগ্রী উন্নত করে যা বার্ধক্য রোধ করে।
হাড়: ইস্ট্রোজেন হাড়ের শক্তি রক্ষা করতে এবং হাড়ের ক্ষয় রোধে সহায়তা করে।
লিভার এবং হার্ট: হরমোনটি লিভারের কোলেস্টেরল উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে, হৃদপিণ্ড এবং ধমনীগুলোকে রক্ষা করতে সহায়তা করে
ইস্ট্রোজেন লেভেল রক্ত পরীক্ষার এর মাধ্যমে নির্ধারন করা যায় । একেক জনের শরীরে ইস্ট্রোজেন এর পরিমান একেকরকম হয়ে থাকে মাসিক চলাকালীন সময়ে এবং পরবর্তীতে যখন মাসিক বন্ধ ( menopause ) হয়, তখন এর পরিমান অন্যরকম হয় ।
২) প্রজেস্টেরন :
প্রজেস্টেরনকে (Progesterone) বলা হয়ে থাকে প্রেগ্নেন্সি হরমোন । অভারিতে প্রজেস্টেরন নামক এই লৈঙ্গিক হরমোন ( female sex hormone ) অভ্যুলুশন ( ovulation) এর পরে তৈরী করে থাকে . এবং মাতৃত্ত্বকালীন সময়ে প্লাসেন্টা ( placenta ) কিছু প্রজেস্টেরন তৈরী করে থাকে ।
প্রজেস্টেরন এর প্রধান কাজ হলো :
ইউটেরাসের লাইনিং তৈরী করা যাতে করে নারীর এগ বা ডিম্বানু ফার্টিলাইজড বা নিষিক্ত হতে পারে ,কারন একটি নিষিক্ত ডিম্বানুর মাধ্যমেই জাইগোট তৈরী হয় ,জাইগোট থেকে ভ্রূন এবং এই ভ্রূন থেকে পরবর্তিতে একটি পরিনত সন্তান পৃথিবীর আলো দেখে।
এই হরমোন মাতৃত্ত্বকালীন সময়েও অনেক সাহায্য করে।
অভ্যুলুশন এর পরে ইস্ট্রোজেন যাতে তৈরী না হতে পারে , সেখানে ভূমিকা পালন করে । তার মানে দাড়লো ইস্ট্রোজেন তৈরী হওয়াকে বাধা প্রদান করে।
আসো এক নজরে জেনে আসি প্রজেস্টেরনের প্রধান কাজ কি কি ।
প্রজেস্টেরন মাসিক চক্র কে নিয়ন্ত্রন করে এবং একজন নারীর শরীরকে মাতৃত্ত্বের জন্য তৈরী করে । প্রজেস্টেরনের ইউটেরাসের (uterus) এর লাইনিং(যকে এন্ড্রোমেট্রিয়াম বলে) কে গাড়ো করে এবং এর ফলে মেয়েদের শরীরে ইমপ্ল্যানটেশন (Implantation) এর জন্য একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরী। তার মানে দাড়ালো এই হরমোন ডিম্বানুকে নিষিক্ত (ফার্টিলাইজড) করে ইমপ্ল্যানটেশন এবং প্রেগনেন্সিতে সাহায্য করে।
আর যদি ডিম্বানু নিষিক্ত না হয় , তাহলে প্রজেস্টেরন পরিমানে কমতে থাকে . এর ফলে গাড়ো হয়ে যাওয়া এন্ডোমেট্রিয়াম ভেঙে যায় এবং আবার মাসিক শুরু হয় । তার মানে দাড়ালো প্রজেস্টেরন গর্ভাবস্থায় মাসিক বন্ধ রাখতে সহায়তা করে এবং সাধারন সময়ে মাসিক কে পরিচালিত এবং নিয়ন্ত্রন করে।
এছাড়াও প্রজেস্টেরন স্তন্যপান (lactation) এ সাহায্য করে।
নারীদের প্রজনন তন্ত্রে কোনো অস্বাভাবিক অবস্থা দেখা গেলে , শরীরে থাকা প্রজেস্টেরন এর পরিমান নির্নয় করা হয়।
উদাহরন-
অনেক সময় নিয়মিত অভ্যুলুশন না হলে মাসিক অনিয়মিত হয়ে যায় ,তাই অভ্যুলুশন ঠিক মত হচ্ছে কিনা সেটা নির্নয় করার জন্য প্রজেস্টেরন লেভেল টেস্ট করে দেখা হয়।
এছাড়াও বন্ধাত্ত্বের পেছনের কারন নির্ধারনেও প্রজেস্টেরন লেভেল নির্নয় কর হয়।
এছাড়াও গর্ভপাত বা অ্যাক্টোপিক গর্ভাবস্থা (miscarriage or ectopic pregnancy) হয়েছে কিনা সেটা দেখার জন্য ও প্রজেস্টেরন লেভেল টেস্ট করা হয় ।
প্রজেস্টেরন লেভেল বেশি হলে অনেক সময় ডিম্বাশয়ের সিস্ট দেখা যায় ।এছাড়াও জন্মগত অ্যাড্রিনাল হাইপারপ্লাজিয়া যা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত গ্রন্থাগুলি অ্যাড্রিনাল গ্রন্থিকে প্রভাবিত করে যার ফলে অ্যাড্রিনাল ক্যান্সার বা ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। সাধারনত প্রেগ্নেন্সির সময়ে প্রজেস্টেরনের পরিমান বেড়ে যায় , এছাড়া জণ্মনিরোধক মেডিসিনে (ফিমেল বার্থ কন্ট্রোল পিল) প্রজেস্টেরন থাকে ,সুতরাং যারা পিল খেয়ে থাকেন ,তাদের এই হরমোন এর লেভেল পরিমানের চেয়ে শরীরে বেশি বেড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে।
আবার প্রজেস্টেরনের পরিমান যদি প্রয়োজনের তুলনায় শরীরে কমে যায় , সেক্ষেত্রে আবার কিছু শারীরিক সমস্যা দেখা দেয় । যেমন অনিয়মিত মাসিক ,বন্ধ্যাত্ত্ব , অ্যাক্টোপিক গর্ভাবস্থা,গর্ভপাত
দুর্বল ডিম্বাশয়ের কার্যক্ষমতা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে।
আর আরেকটি হরমোন মেয়েদের শরীরে থাকে থাকে ,আর সেটা হলো টেস্টেস্টেরন ।যদিও এটা একটি পুরুষ লৈঙ্গিক হরমোন (মেইল সেক্স হরমোন) কিন্তু অল্প পরিমানে মেয়েদের শরীরেও থাকে । টেস্টেস্টেরন আমাদের হাড় এবং মাংসপেশীকে স্বাস্থ্যকর রাখে ,এবং সেক্স ড্রাইভকে রক্ষা করে।
Recent Comments