আমাদের ছোটবেলা থেকে শুধু “রেসাল্ট ভালো করতে হবে” , এই চিন্তাটাই মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয় । জীবনে সফল হতে হলে যেমন ভালো রেসাল্ট অনেক গুরুত্ত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে ,ঠিক তেমনি আরো অনেক কিছুই আছে যা আমাদের সুনির্দিস্ট গন্তবে পৈছাতে সাহায্য করে । আজকের পৃথিবীটা একটু অন্যরকম , যার সাথে আমরা স্কুলে পড়া অবস্থায় অনেক ক্ষেত্রেই পরিচিত হতে পারিনা , এর পেছনের অন্যতম প্রধান কারন হলো , সব স্কুলের সিস্টেম ,পরিবেশ , সিলেবাস সমান না । মিডিয়াম অব ইন্সট্রাকশন – বাংলা মিডিয়াম , ইংলিশ মিডিয়াম এবং ইংলিশ ভার্সন ,মাদ্রাসা, কারীগরী এবং গনশিক্ষা কার্যক্রম সহ আরো অনেক শিক্ষাপদ্ধতি চালু থাকার কারনে আমরা সবাই সমান সুযোগ সুবিধা পাই না । তবে আমি বিশ্বাস করি ,দেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে , একদিন শিক্ষা ব্যাবস্থায় এই বৈষম্য দূর হবে । আমরা চাইলেই একদিনে শিক্ষা ব্যবাস্থাকে বদলে দিতে পারবনা , তাই অভিযোগ না করে ,আমাদের হাতের নাগালে এবং ক্ষমতার মধ্যে যেসব হাতিয়ার আছে সেসবকে কাজে লাগিয়ে আমরা আমাদের জীবনে অনেক উন্নতি লাভ করতে পারি ।
আর তাই আজকের এই লেখাটা তাদের জন্য , যারা স্কুল ,কলেজ অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছো অথবা কোনো কারনে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারোনি ,তাদের জন্য ।
১) প্রথমেই বলতে চাই ,কখনো নিজের জন্ম পরিচয় , জন্মস্থান , এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থান নিয়ে লজ্জ্বা পাবে না। যদি জীবনে ভালো কিছু করতে চাও , নিজের শিকড়কে ভুলে গেলে চলবে না । আমি জানি , আমাদের সবার পারিবারিক , এবং আর্থ- সামাজিক অবস্থা সমান হয় না , তাই আমরা সবাই সমান সুযোগ-সুবিধা পাইনা ।তাই যে যেখানেই পড়াশোনা করছো না কেনো , যেভাবেই থাকো না কেনো , “ কখনো মন ছোট করবে না “। আত্নবিশ্বাসী হয়ে এগিয়ে যাও , জীবন তোমার কাছে সুন্দর ভাবে ধরা দিবে ।
2) আমরা বেশিরভাব সময়ে আশেপাশের পরিবেশ থেকে দেখে অনেক কিছু শিখি । তাই আমরা কাদের সাথে মিশছি , কাদের সাথে চলাফেরা করছি ,কারা আমাদের বন্ধু- এইসব কিছুই আমাদের জীবনের লক্ষ্যকে সামগ্রিকভাবে প্রভাবিত করে ।তাই পড়াশোনার পাশাপাশি তোমাকে তোমার লক্ষ্য অনুযায়ী বন্ধু নির্বাচন করতে হবে এবং অন্তত একজন মেন্টরনকে খুজে নিতে হবে , যে তোমাকে অনুপ্রানিত করবে । হতে পারে সে একজন অনলাইন মেন্টর ,হয়তোবা সে তোমার দেশেরই না ,কিন্তু তুমি অনলাইনে তার কাজ দেখো, তার লেখা পড়ো অথবা ভিডিও দেখো ,সে তোমাকে ভালো কাজ করার জন্য অনুপ্রেরনা জোগায় ।
৩) আবার তোমার মেন্টর তোমার খুব কাছের কেউ হতে পারে , হয়তো তোমার ভাই অথবা বোন , তোমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোনো সিনিয়র ,অথবা তোমার কোনো এক শিক্ষক । স্কুল কলেজের গন্ডি পেরিয়ে যখন তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করবে , তখন দেখবে তুমি অনেক নতুন কিছুর সাথে পরিচিত হবে। এতদিন যা জেনে অথবা দেখে এসেছো , সবকিছুর সাথে তুমি নিজের অভিজ্ঞতার অনেক কিছুই মিলাতে পারবে না । তার মানে তুমি বাস্তবতায় পা দিয়েছো । তখন তুমি বুঝতে শিখবে , পড়াশোনার পাশাপাশি তোমার নিজেকে আরো অন্যভাবে তৈরী করতে হবে,চাকরি ক্ষেত্র এবং ভবিষ্যত জীবনের জন্য । তখন তুমি নিজের পরিচিত গন্ডি থেকে বেড়িয়ে বাইরে কাজ করবে , অনেক সুযোগ আসবে , প্রত্যেকটি ভালো সুযোগকে গ্রহন করো । তুমি সব ধরনের কাজ করার ক্ষমতা এবং অধিকার রাখো , যতক্ষন না পর্যন্ত তোমার কাজ অন্য কারো ক্ষতির কারন না হয় ।
আর এভাবেই কখনো তুমি “পকেট মানি” উপার্জনের জন্য টিউশনি করবে, লিখবে, কখনোবা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ক্লাবে কাজ করবে , ইভেন্ট অর্গানাইজ করবে , কখনোবা তোমার উপস্থাপনা মঞ্চে মুগ্ধতা নিয়ে আসবে , তোমার আবৃত্তিতে নিঝুম সন্ধা নামবে, কখনো তোমার গানের সুরে আকাশটা একটু অন্যরকম সুন্দর লাগবে ,কখনোবা তোমার বিতর্কে বিচারকরা চায়ের কাপে ঝড় তুলবেন , তোমার নৃত্তে আমাদের লোকজ সংস্কৃতি আবার জেগে উঠবে ,কখনো তোমার আকা দৃশ্যপটে আবার গ্রামের আদি চেহার ফুটে উঠবে ,কখনোবা তোমার লেখনিতে তোমার জন্মস্থানের অনিয়মগুলো ফুটে উঠবে , তোমার করা ক্যম্পেইনে দেশ এ জন সচেতনতা গড়ে উঠবে ।
আর এই প্রত্যকেটি সহ-শিক্ষামুলক কার্যক্রম তোমাকে তোমার ভবিষ্যত জীবনের জন্য তৈরী করে নিবে । তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখার সাথে সাথে পড়াশোনার পাশাপাশি নিজেকে অন্যান্য কাজে যুক্ত করবে , এতে করে নিজের নেটওয়ার্কিং তৈরী হবে, আত্নবিশ্বাস বাড়বে , নিজের সফট স্কিল গুলো তৈরী হবে যা ভবিষ্যতের চাকরিক্ষেত্রের জন্য তোমাকে যোগ্য করে তুলবে। আর এভাবেই তোমাকে জব এর ইন্টারভিউতে খালি সিভি নিয়ে যেতে হবে না । চাকরি নাই কথাটা ভুল ,তোমার দক্ষতা থাকলে তুমি অনেক কিছুই পেয়ে যাবে । আর এই পুরো প্রক্রিয়ায় তোমার কিছু বিশ্বাসযোগ্য মেন্টর থাকা দরকার , যারা তোমাকে অনুপ্রানিত করবে , সাহায্য করবে , ভালো কাজের প্রশংসা করবে এবং তোমার ভুলগুলো সঠিক ভাবে ধরিয়ে দিতে পারবে ।
৪) এতোক্ষন তো বললাম শিক্ষা এবং ব্যাক্তিগতজীবনে মেন্টর থাকার প্রয়োজনীয়তা ।সবসময় ভালো মানুষের পাল্লায় পরবে – জরুরী না । অনেক সময় আমরা চলার পথে এমন অনেক মানুষের দেখা পাই ,যারা আমাদের চলার পথকে সুগম করে তুলেন না , এমন কারো দেখা যদি পেয়ে যাও , নীরবে নিজের রাস্তা মেপে নাও , সেখান থেকে বেড়িয়ে এসো । তবে তোমার কাজ যদি ভালো হয় , ইচ্ছা শক্তি যদি প্রবল থাকে , তুমি যদি অনেক আত্নপ্রত্যয়ী হও , সৎ থাকো ,তাহলে চলার পথে ভালো মেন্টরের দেখা পাবেই পাবে , এতটুকু আমি বিশ্বাস করি ।
৫) এই তো গেলো তোমাদের ব্যাক্তিগত , সামাজিক অথবা শিক্ষাজীবনে মেন্টর এর কথা । এবার আসি একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে । তোমাদের মধ্যে অনেকেই আছো যারা স্কুলে অথবা কলেজে পড়া অবস্থায় ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ো । আমি অবশ্যই ছাত্র রাজনীতির বিপক্ষে না , কারন এই পর্যন্ত আমাদের দেশে যত বড় পরিবর্তন এসেছে সব ছাত্রদের মাধ্যমেই পরিচালিত এবং সংগঠিত হয়েছে । কিন্তু আজকের দিনে , ছাত্র রাজনীতি কেমন? একটু প্রশ্নবিদ্ধ নয় কি? কোন দিকে এগোচ্ছে? পড়াশোনা ঠিক মত না করে , নেতাদের পেছনে ঘুরে বেড়ানোর রাজনীতিকে আমি সমর্থন করি না । সোশ্যাল মিডিয়াতে আমি অনেক ছাত্রদের দেখি , বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের সাথে ছবি। নিজের কোনো এক্টিভিটি নেই , এসব নেতাদের পেছনে ঘুরলে হবে? ছবি তোলা দোষের কিছু না । কিন্তু যার সাথে আছো , সে তোমার সঠিক মেন্টর তো? ভেবে দেখো । রাজনীতি করতে চাও , ভালো কথা , ঠিকমত পড়াশোনা করো । রাজনীতির চেহার এখন বদলে গেছে, আরো কয়েক বছরে আরো বদলে যাবে । স্থানীয় পর্যায়ে যারা খুব অল্প বয়সে এখনই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছো ,তাদের বলবো “ঘুরে দাড়াও” । এই বয়সটা মিছিল করে রাজপথে নেতাদের সাথে ছবি তোলার বয়স না । নিজেকে গড়ে নেয়ার বয়স । নিজেকে তৈরী করো , রাজনীতির মাঠ তোমাকে নিকট ভবিষ্যতে খুজে নিবে , নিজে থেকেই । আমাদের স্থানীয় রাজনীতিতে একটি আমূল পরিবর্তন দরকার ,এটি দেশকে সম্পুর্নভাবে বদলে দিবে বলে আমি বিশ্বাস করি । এজন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে , এক হয়ে কাজ করতে হবে । প্রজেক্টভিত্তিক রাজনীতি চালু করা এখন সময়ের দাবি । এসব মিছিল , মিটিং, চিৎকার-চেচামেচি আমাদের প্রজন্ম পছন্দ করে না ।এই প্রজন্ম কাজ করতে চায় । তাই তোমাকে সঠিক মেন্টরকে বেছে নিতে হবে , আর না পেলে “ যদি তোর ডাক শোনে কেউ না আসে , তবে একলা চলরে ” গানটির কথা মনে করো।
কিছু কঠিন বাস্তবাতা বলি। যারা বাবার হাত ধরে রাজনীতিতে আসে তাদের তেমন সমস্যায় পড়তে হয় না ।যাদের নিজেদের ফ্যামিলি বিজনেস আছে তাদেরও সমস্যা হয় না , কিন্তু আমি আমার খুব সল্প অভিজ্ঞতায় বলতে পারি , যারা স্থানীয় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার পাশাপাশি ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত আছেন এবং আর্থ সামাজিক অবস্থানে একটি পিছিয়ে , তাদের সমস্যায় পড়তে হয় । এই ছেলেমেয়েগুলোকে কাজে লাগিয়ে স্থানীয় অনেক কাজ অনেক সফলভাবে করা সম্ভব । কিন্তু যদি প্রজেক্ট ই না থাকে , তাহলে তারা কাজ কোথায় করবে ?
আর এজন্যই আমাদের জনপ্রতিনিধিদের বিকেন্দ্রীকরনে নজর দিয়ে সেখানে অনেক বেশি মনোযোগীহতে হবে। ঢাকায় আমাদের ছাত্র ছাত্রীদের যেতে হবে না(কারন চাইলেও সবাই যেতে পারেনা) , অনেক সুযোগ-সুবিধা ঢাকা থেকে শ্রীমংগলে নিয়ে আসা সম্ভব । এজন্য আপনাদের শুধু রাস্তা ঘাট , বাড়ী ঘর , শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বানানোর পাশাপাশি অন্যান্য উন্নয়ন নিয়েও ভাবতে হবে । দুইহাজার একুশ সালে সারা বিশ্বব্যাপী চতুর্থ শিল্প বিপ্লব হতে যাচ্ছে । এই স্থানীয় পর্যায়ে পিছিয়ে পড়া তরুনদের দক্ষ করে তুলতে না পারলে , দেশ এগিয়ে যাবে কি করে? শুধু সভা সমাবেশে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে- এসব কথা আমরা শুনতে চাইনা । উন্নয়নের নতুন মানে বুঝতে চাই , দেখতে চাই ,কথার সাথে কাজের মিল চাই । আর শ্রীমংগলের অনেক ছাত্র-ছাত্রীরা আছে যারা দেশে এবং বিদেশে ভালো ভাবে নিজেদের একটি শক্ত অবস্থানে নিয়ে গেছেন , অনেক ভালো কাজ করছেন । তাদেরও শ্রীমংলে ফিরে আসা এখন জরুরী । অন্তত মাসে একদিন ,অথবা ছয় মাসে একদিন ,আর সেটা সম্ভব না হলেও বছরে একদিন । আর একেবারে আসতে না পারলেও , যারা কাজ করছে বা করবে ,তাদেরকে দূর থেকে অনুপ্রেরনা দিলেও হবে ।
৬) শিক্ষাব্যাবস্থায় আমুল পরিবর্তনের স্বপ্ন আমি এই মুহূর্তে দেখছিনা ,যদিও খুব বেশী দরকার। তবে সবার আগে আমি মানবিক পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখি । আমি দেখতে চাই , শিক্ষক –শিক্ষিকা অথবা মা বাবা তার সন্তানের ভালো বন্ধু হবেন , সে ভুল করলে তাকে বকাঝকা না করে বুঝিয়ে বলবেন, তাকে উঠে দাড়ানোর সুযোগ দিবেন , তার মানষিক সাস্থ্য সুরক্ষায় ভূমিকা রাখবেন । আমি বিশ্বাস করি , শুধু ভালো ব্যাবহার এবং কাউন্সিলিং দিয়ে আপনি উঠতি বয়সের তরুনদের সঠিক পথে আনতে পারবেন । কিশোর অপরাধ কতটা ভয়াবহ রুপ নিচ্ছে, আপনি জানেন কি? কিন্তু বেড়ে উঠার সময়ে , অনেক ঊঠতী বয়সীরা একটু ভালো ব্যাবহার বা সহানুভূতী পায় না দেখেই , আরো খারাপ পথে পা বাড়ায় । আপনার সন্তানকে মানষিক ভাবে সাপোর্ট দিন , বাকিটা পথ সে একাই পাড়ি দিতে পারবে । জীবনে শুধু সাফল্য আসে না , চলার পথে অনেক বাধা আসে । তাই ছোটবেলা থেকে সন্তানকে একজন সফল মানুষ হতে ,শুধু সেটা না শিখিয়ে বরং ব্যার্থতা আসলে কিভাবে নিজেকে সামলে নিতে হবে , সেই শিক্ষাটুকুও দিন।
আর কি বলবো? অনেক কিছুই বলার আছে ,তবে এতটুকু বলবো আমি যেখানেই কথা বলি অথবা লিখি , আমি চেস্টা করি , আমি আমার প্রজন্মকে প্রতিনিধিত্ত্ব করতে , আমার প্রজন্মের একজন প্রতিনিধি হয়ে কথা বলতে , আর এই লেখাটি তারই ফলসরূপ । সবাই ভালো থাকবেন , সুস্থ থাকবেন ।আর কাউকে সাহায্য করতে না পারলেও অন্তত ক্ষতি করবেন না । ভালো কথা বলুন এবং সবাইকে ভালো কাজে উথসাহিত করুন ।
Recent Comments