খুব ছোটবেলা থেকে আমাদের মধ্যে ছেলে এবং মেয়ের পার্থক্যটা চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয়  ।এই যেমন আমাদের  খেলনা সামগ্ররী কথাই চিন্তা করা যাক । একটা মেয়েকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খেলনা হিসেবে রান্না ঘরের হাড়ি –পাতিল ,পুতুল ঘর সাজানোর উপকরন হাতে  ধরিয়ে দেয়া হয়।আর একটা ছেলেকে কিনে দেয়া হয় খেলনা  গাড়ী, ইলেক্ট্রনিক্স জিনিসপত্র ,গেম/ভিডিও প্লেয়ার অথবা এরোপ্লেণ । কেনো ,একটা মেয়ে কি পাইলট হতে পারে না ?একটা মেয়ে কি মহাকাশে লাল-সবুজের পতাকা উড়াতে পারেনা? হ্যা, সবই সম্ভব ,অবশ্যই সম্ভব। আমাদের আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাজার তরুনীর  ভিন্নধর্মী সাফল্যের গল্পটা কিন্তু আমাদেরই ।

তবুও পরিবার থেকেই শুরু হয় এই পার্থক্যের মোড়ক উন্মোচন ।স্টেরিওটাইপিং নামক শব্দটা এখানে খুব  প্রভাব বিস্তার করে।আমাদের পরিবারও কিন্তু  জানে যে একটা  মেয়ে চাইলেই নিজের পছন্দ মত যে কেনো পেশা বেছে নিতে পারে ।আশেপাশে বাংলাদেশী  তরুনীদের সাফল্যগাথা অন্তত এটাই বলে । কিন্তু তবুও কোথায় জেনো আমরা একটু থেমে আছি ।ছোটবেলা থেকে একটা মানুষকে আশেপাশের উপাদান দিয়ে ছেলে ও মেয়ের পার্থক্য না বুঝিয়ে ,যদি তার শারীরিক ও মানষিক পরিবর্তন দিয়ে বোঝানো হয় ,তাহলে তার মানষিক স্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকবে ,সে নিজেকে নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগবে না ,নিজের শারীরিক ও মানষিক পরিবর্তন নিয়ে লজ্জ্বা পেয়ে থেমে থাকবেনা , জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই আত্নপ্রত্যয়ী এবং আত্নবিশ্বাসী হয়ে ঊঠবে ।

আর এই জীবনমুখী অপরিহার্য  শিক্ষার নাম সেক্স এডুকেশন ।তাই নিজেকে জানার অপর নামই সেক্স এডুকেশন । পরিবারই পারে এক্ষেত্রে অনেক অপরিহার্য ভুমিকা রাখতে। একটি শিশুর প্রধান বেড়ে উঠার মাধ্যম কিন্তু এই পরিবারই ।

সচেতনতা সৃস্টির আগে একটু ঘুরে আসি বিজ্ঞ্বানসম্মত ব্যাখায়।কেনো একটা মেয়ের  বেড়ে ওঠার সাথে সাথে  ভিন্ন ভিন্ন  শারীরিক এবং মানষিক পরিবর্তন আসে ।

একটা ছোটো মানুষ একটু একটু করে মেয়ে  হয়ে  বেড়ে ওঠে ,তবে সবার আগে সেও একটা মানুষ । বয়ঃসন্ধিতে একটা মেয়েকে অনেক ধরনের শারীরিক এবং মানষিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয় ।প্রত্যেকটা  পরিবর্তনই  স্বাভাবিক , চোখেব পড়ার মত এবং সমান গুরুত্ত্বপূর্ন । চলো এক নজরে দেখে আসি সেই পরিবর্তনগুলোকে ,যদি তুমি বয়ঃসন্ধিতে থেকে থাকো তাহলে এটাও  জেনে রাখো তোমার সাথে যা ঘটে চলেছে ,তোমার শারীরিক এবং মানষিক পরিবর্তন খুবই স্বাভাবিক একটা প্রক্রিয়া ।আর যদি তুমি বয়ঃসন্ধিত পার করে একটু পরিনত বয়সের দিকে যাচ্ছো ,তাহলে তুমি  জেনে রাখো এবং যখনই সুযোগ পাবে ,তোমার চেয়ে বয়সে ছোট এমন কেউ যদি বয়ঃসন্ধিতে থাকে, তাহলে তার সাথে এই  পরিবর্তনগুলো নিয়ে খোলামেলা কথা বলবে ,তাদের মনে সাহস যোগাবে যাতে তারা আত্নপ্রত্যয়ী হয় ,যাতে বয়ঃসন্ধির এতো পরিবর্তনের সাথে হারিয়ে না  যায় ,তাদের বয়ঃসন্ধি যাতে ভয়ের না হয়ে জয়ের হয় ।

  • একটা মেয়ে একটু বড় হওয়ার সাথে সাথে প্রথম যে শারীরিক পরিবর্তন চোখে পড়ে এবং অনুভব করা যায় ,সেটা হলো ব্রেস্ট এর সাইজ এবং নিপল  এর পরিবর্তন ।অনেকেই এই পরিবর্তন নিয়ে অনেক দ্বিধায় ভোগে ,ছোটবেলার জামা ছেড়ে নিজেকে ব্রা এর আবরনে একটু মানিয়ে নেয়া অথবা ব্রেস্ট এর সাইজ ছোট/ বড় –এইসব নিয়ে অনেকেই দ্বিধায় পড়ে । একটু লজ্জ্বা পায় ।খেলার মাঠ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয় ।এভাবেই নিজের একা একটা পৃথিবী তৈরী করে নেয় আর এভাবেই হয়তো মানষিক ভাবে ভেঙ্গে পড়ে আর বয়ঃসন্ধিতে এভাবে নিজেকে গুটিয়ে নেয়ার ফলাফল খুব একটা ভালো হয়না ।  
  • আবার  বয়সন্ধিতে মেয়েরা তাদের পেলভিক এড়িয়াতে  একটু ওজন লাভ  করে থাকে ,তারপর হিপ একটু ভারী হতে পারে । এই পুরো স্বাভাবিক  প্রক্রিয়া অতোপ্রতোভাবে বয়ঃসন্ধিতে একটা মানুষকে একটা মেয়েতে পরিনত করে।
  • আরও একটি গুরুত্ত্বপুর্ন শারীরিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় । আর সেটা শরীরের বিভিন্ন স্থানে লোম গজাতে থাকে । বিষেশত বগলে ,পিউবিক এড়িয়াতে,পায়ে বেশী লোম গজাতে দেখা যায় ।বয়স বাড়ার সাথে সাথে লোমের ঘনত্ত্ব আরও বাড়তে থাকে। আর একারনে অনেক মনে মনে লজ্জ্বা পেয়ে থাকে অথবা হীনমন্যতায় ভোগে কিভাবে লোম ফেলে দিতে হবে ,কোনো হেয়ার রিমোভাল ব্যাবহার করতে হবে কিনা ,রেজার ব্যাবহার করলে কি শরীরে দাগ পড়ে যাবে  কিনা।  কিন্তু তখন এটা জানা খুবই  গুরুত্ত্বপুর্ন ,যে সব কিছুই হচ্ছে  হরমোনাল পরিবর্তন এর কারনে ,তাই এসব নিয়ে লজ্জ্বা না পেয়ে পরিবারের সাথে কথা বলতে হবে ,না জানলে জেনে নিতে হবে।
  • এবার আসা যাক জেনিটাল অরগান অথবা সেক্স অরগান এর পরিবর্তন এর কথায়,  যার উপর ভিত্তি করে একটা ছেলে অথবা মেয়েকে আলাদা করা হয় । বয়ঃসন্ধিতে একটা মেয়ের  ভেজাইনা তে অনেক সময়  ফ্লুইড এর সৃষ্ঠি হয় ,মাসিক শুরু হয়, মাসিক কখনো অনিয়মিত হতে পারে ,কখনোবা ব্যাথা থাকতে পারে তল পেটে ।এই প্রত্যকটা পরিবর্তনের পেছনের  বিজ্ঞানসম্মত কারন হলো ,এই পরিবর্তগুলোই মনে করিয়ে দেয় মাতৃত্ত্ব নামক স্বর্গীয় উপহারের কথা, যা একটা মেয়েকে ছেলেদের চেয়ে সবচেয়ে বেশি আলাদা করে,সবচেয়ে বেশি সম্মানের জায়গায় অধিষ্ঠিত করে।
  • বয়ঃসন্ধি থেকে ই একটা মেয়ের রিপ্রডাক্টিভ সিস্টেম (প্রজননন স্বাস্থ্য ) এর অনেক পরিবর্তন আসতে শুরু করে ।অনেকে অংগ-প্রত্যংগ ধীরে ধীরে পরিনত হতে থাকে। ফেলোপিয়ান টিউব ,ইঊটেরাস ,ভেজাইনা ধীরে ধীরে তার কার্যক্রম শুরু করে, হরমোন তৈরী হতে থাকে ,আর এর সাথে অনেক শারীরিক এবং মানষিক পরিবর্ত আসতে থাকে । এই যেমন – অভারিতে ডিম্বানু/এগ তৈরী হয় প্রতি মাসে ,আর এই অভারি ই হলো ফিম্যাল রিপ্রডাক্টিভ সিস্টেমের প্রধান অংগ।অভারিতে তৈরী হওয়া ডিম্বানই শুক্রানুর সাথে মিলিত হয়ে জাইগোট তৈরী করে যা পরবর্তীতে একটা পরিনত সন্তান জন্ম দিতে সক্ষম ।
  • আবার মাসিকের সাথে মাতৃত্ত্বের খুবই গুরুত্ত্বপূর্ন যোগসূত্র রয়েছে।নারীদের রিপ্রডাক্টিভ সিস্টেমের  এর  প্রধান অংগ  হল অভারি (Ovary) এবং প্রত্যেকের দুইটি অভারি থাকে ফিম্যাল হরমোন  উৎপাদন  করে ।
  • আর অভারিতে যে ফলিকল থাকে তা ডিম্বানু(অভাম /এগ) তৈরী করে । প্রত্যেক মাসে একটা পরিনত ডিম্বানু/এগ ইউটেরাইন টিউব অথবা ফেলোপিয়ান টিউবে প্রবেশ করে এবং ইঊটেরাসে প্রবেশ করে এবং প্রত্যেক মাসে এন্ডোমেট্রিয়াম(ইঊটেরাসের লাইনিং ) ব্লাড এবং ফ্লুইড দ্বারা পরিপক্ক্ব হয় ।
  • এতে করে যে ডিম্বানু তৈরী হয়,তার মধ্য থেকে পরিপক্ক ডিম্বানুকে আলাদা করার জন্য এই এন্ডোমেট্রিয়াম ছাকনি হিসেবে কাজ করে ।আর যদি ডিম্বানু পরিপক্ক্ব  না হয় তাহলে এটা ইঊটেরাসের এর মধ্য দিয়ে লাইনিং এর মাধ্যমে  বের হয়ে আসে। এই বের হয়ে আসাটাকেই ডিসচার্জ  বলে এবং এই প্রত্যেক মাসের ডিসচার্জকেই  মাসিক বলে থাকি ।
  • আবার ইঊটেরাস সংযুক্ত থাকে ভ্যাজাইনার  এর সাথে সারভিক্স  এর মাধ্যমে সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্সের সময় পুরুষের শুক্রানু (স্পার্ম) ফেলোপিয়ান টিউব  এ প্রবেশ করে ডিম্বানুকে পরিপক্ক্ব করার জন্য । আর এই ডিম্বানু এবং শুক্রানু এর জেনেটিক মেটারিয়াল একসাথে মিশে জাইগোট তৈরী করে ।
  • তারপর এই জাইগোট থেকেই ধীরে ধীরে একটা বাচ্চা  পরিনত হতে থাকে ।সম্পুর্ন প্রক্রিয়াকে বলে অভ্যুলোশন  এবং  মাসিক  হচ্ছে মাতৃত্বের  একটা ধনাত্ত্বক চিহ্ন। সহজ ভাষায় ডিম্বানু   তৈরী না হলে মাসিকের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ হবে এবং মাতৃত্বের সম্পুর্ন প্রক্রিয়া সফল ভাবে সম্পন্ন হবে না ।
  • আর এই সচরাচর পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় ভালো খাদ্যাভাস খুবই জরুরী ।এই যেমন প্রচুর পানি পান করতে হব্বে ,শাক-সবজি-মাছ-ফল-মূল খেতে হবে ।এই সময়টাতে বাইরের খাবার এই যেমন ফাস্ট ফুড, তেলের ভাজা পুরা বেশি একটা না খাওয়াই ভালো কেননা এটা রিপ্রোডাক্টিভ স্বাস্থ্যের জন্য একটু ক্ষতিকর।
  • বয়সন্ধিকালে আমাদের শরীরকে  হরমোন তৈরীর  মেশিন   বলা হয়ে থাকে ।আর এই সময়টাতেই নিত্যনতুন হরমোন তৈরীর কারনে sebaceous (oil producing) glands and sweat glands ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে ।আর এর ফলে ব্রন এবং পিম্পলস হতে পারে ।আর এই সমস্যায় প্রায় সব  তরুনীরাই পড়ে থাকে তাদের বয়ঃসন্ধিতে।
  • আরও একটা সমস্যায় বয়ঃসন্ধিতে অনেকেই পড়ে থাকেন আর সেটা হলো ঘাম । অনেকেই আছে যারা অনেক বেশি ঘামতে থাকে এবং এটি খুব স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া । দুর্গন্ধ হওয়ার প্রধান কারন হলো ব্যাক্টেরিয়া জন্মাতে থাকে ,আর তাই বেশি ঘাম দুর্গন্ধের কারন হতে পারে।

উপরের প্রত্যেক্টা কারন এর সাথে  বয়সঃন্ধিকালে প্রত্যেক্টা মেয়েকেই পরিচিত হতে হয় । আর একটু একটু করে ,একটা ছোট মানুষের  একটা মেয়ে হয়ে ঊঠার পেছনের গল্পটা হলো হরমোনাল পরিবর্তন ,যার ফলে এসব পরিবর্তন  লক্ষ্য করা যায় ।সর্বোপুরি ,একটা মানুষকে ছেলে অথবা মেয়ে হিসেবে আলাদা করার প্রধান হাতিয়ার হওয়া উচিত  তার শারীরিক এবং মানষিক পরিবর্তনের বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা । সামাজিক কোনো বাধা অথবা কুসংস্কার যেনো ছেলে অথবা মেয়েকে আলাদা করার হাতিয়ার না হয়,সেজন্য সেক্স এডুকেশন বিস্তারের কার্যক্রম পরিবার থেকেই শুরু হওয়া উচিত ।