সাধারনত একজন মানুষের ১১-১৯ বছরের সময়কালকে বয়ঃসন্ধিকাল বলে।বয়ঃসন্ধিকাল হল যখন একটি বাচ্চার শরীর প্রাপ্ত বয়স্কের দিকে যায়। আর এইবয়সন্ধিকালেই শুরু হয় নানা রকমের শারীরিক পরিবর্তন ।আর এই পরিবর্তনের প্রধান কারন হলো এই সময়ে আমাদের শরীরে সেক্স হরমোন বা এডাল্ট হরমোন তৈরী হয় যাকে বাংলায় লৈঙ্গিক হড়মোন বলে। সাধারনত আট থেকে ১৪ বছর বয়সের মধ্যেই বয়সন্ধিকাল শুরু হয় । তবে ছেলেদের চেয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মেয়েদের বয়সন্ধিকাল শুরু হয় । রিসার্চ অনুযায়ী , মেয়েদের ক্ষেত্রে নয় থেকে এগারো বছর বয়সেই এই বয়ঃসন্ধিকাল শুরু হয় । তবে বয়সন্ধিকাল কারো তাড়াতাড়ি শুরু হয় ,কারো একটু দেরিতে , এটি একেক জনের ক্ষেত্রে একেক রকম হতে পারে।
বয়ঃসন্ধিকালে মেয়েদের শরীরে ইস্ট্রোজেন এবং প্রজেস্টেরন (Estrogen and progesterone) নামক লৈঙ্গিক হরমোন তৈরী হয় ,এদের ফিম্যাল সেক্স হরমোন বলে। ইসট্রোজেন সাধারনত ব্রেস্ট এর আকার এবং আকৃতি পরিবর্তন করে। এছাড়াও মেয়েদের যে সব প্রজনন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আছে (উদাহরনঃ ভেগাইনা/যোনী,ইউটেরাস ,ফেলোপিয়ান টিউব), এই হরমোন এই প্রজনন অংগপ্রত্যংগ গুলোকে ধীরে ধীরে পরিনত করে । আরো কিছু গুরুত্ত্বপূর্ন কাজ আছে ,সেগুলো হলো আমাদের লম্বা করা ,এবং শরীতে ফ্যাট জমা করে যা waist, hips and buttocks কে গঠন এবং পরিনত করে।
আর বয়ঃসন্ধিকালের এই দুটি লৈঙ্গিক হরমোন আমাদের মাসিক চক্রকে (Menstrual cycle)কে নিয়ন্ত্রন এবং পরিচালিত করে।
সুতরাং এই সেক্স বা এডাল্ট হরমোন গুলোর কারনে বয়সন্ধিকালে যে সব শারীরিক পরিবর্তন সব মেয়েদের মধ্যে আসে ,তার মধ্যে অন্যতম প্রধান তিনটি হলোঃ
- ব্রেস্ট এর পরিবর্তন
- মাসিক
- ভেজাইনার ডিসচার্জ
১) ব্রেস্ট: বয়:সন্ধিকালে প্রত্যেক্টি মেয়েদের ব্রেস্ট এর সাইজ এবং নিপল এর পরিবর্তন হয় ।কারো ব্রেস্ট এর আকার ও আকৃতি ছোট আবার কারো বড় হয়ে থাকে ,তবে আকার/আকৃতি যাই হোক না কেনো ,এটি খুবই স্বাভাবিক বিজ্ঞানসম্মত প্রক্রিয়া ।আর ইস্ট্রোজেন নামক হরমোন এই ব্রেস্ট এর পরিবর্তন এর জন্য দায়ী।
২) মাসিক/পিরিয়ড : ডিম্বাশয়ে (অভারি) অনেক ডিম্বানু (এগ)) থাকে । বয়সন্ধিকালে পৌছার পর প্রতিমাসে সেক্স/লৈঙ্গিক হরমোন তৈরী হয়। এর ফলে অভারিতে এগ বা ডিম্বানু পরিনত হতে থাকে এবং অভারি এই ডিম্বানুকে নির্গত করে করে। এই সম্পূর্ন প্রক্রিয়াকে অভুল্যুশন বলে । এক কথায় মাসিক বা পিরিয়ড আমাদের কে মাতৃত্ত্বের জন্য তৈরী করে। আর এতে সাহায্য করে আমাদের আঠাশ দিনের মাসিক চক্র।
প্রতিমাসে আমাদের ইউটেরাসের লাইনিং এর মধ্য দিয়ে ভেজাইনার মাধ্যমে যে ব্লাড বের হয়ে আসে , সেটাকে সাইন্টিফিক্যালি ডিসচার্জ বলে ।আর আমরা একে মাসিক বা পিরিয়ড বলে থাকি । আমরা সাধারনত একে মাসিক বা পিরিয়ড বললেও , এর সাইন্টিফিক শব্দ মেন্সটড়ূয়েশন(Menstruation)। এখন প্রশ্ন হলো কেনো এই ব্লাড কেনো প্রতি মাসে বের হয়ে আসে? ডিম্বাশয়ে বা অভারিতে যে ফলিকল থাকে তাকে ডিম্বানু বা এগ বলে । এন্ড্রোমেট্রিয়াম অথবা ইউটেরাসের লাইনিং ছাকনি হিসেবে কাজ করে যা পরিনত এবং পরিপক্ক ডিম্বানুকে আলাদা করে ।আর যেসব ডিম্বানু পরিপক্ক হতে পারে না ,তা প্রতিমাসে ইঊটেরাসের লাইনিং এর মধ্য দিয়ে ব্লাড হিসেবে বের হয়ে আসে ,যাকে আমরা পিরিয়ড বলছি ।তার মানে অপরিনত ডিম্বানু মাসিক/ পিরিয়ড এর ব্লাড হিসেবে বের হয়ে আসে,আর পরিনত ডিম্বানু শুক্রনু/স্পার্ম এর সাথে মিলিত হয়ে , শারীরিক সম্পর্কের (Sexual Intercourse) মাধ্যমে নিষেকের ( fertilization) জন্য জাইগোট তৈরী হয়। আর এই জাইগোট থেকে একটি পরিনত সন্তান পৃথীবির আলো দেখে ।
সাধারনত এই মাসিক তিন থেকে সাত দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে থাকে। কারো কারো ক্ষেত্রে বয়সন্ধিকালের শুরুতে মাসিক অনিয়মিত হয় ,ব্যাথা হয় ,তবে এসব স্বাভাবিক। কিন্তু বেশি অনিয়মিত হলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। মাসিকের সময় স্যানিটারি প্যাড এং সুতি কাপড় সবচেয়ে বেশি ব্যাবহার করা হয় আমাদের দেশে । যারা স্বচ্ছল অর্থনৈতিক অবস্থানে আছেন , তারা প্যাড ব্যাবহার করী থাকেন। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে আমাদের সবার আর্থ-সামাজিক অবস্থা সমান না হওয়ার কারনে অনেক মেয়েকে কাপড় ব্যাবহার করে হয় ।এক্ষেত্রে যে কাপড় ব্যাবহার করা হচ্ছে সেটাকে ভালো করে সাবান এবং গরম পানি দিয়ে ধুয়ে কড়া রোদে শুকিয়ে আবার ব্যাবহার করতে হবে ,যাতে করে জীবানুমুক্ত থাকে এবং ব্যাক্টেরিয়া জন্মাতে না পারে। আর যারা প্যাড ব্যাবহার করেন,তাদের তিন থেকে চার ঘন্টা পর পর প্যাড পরিবর্তন করা উচিত। মাসিকের সময় পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখলে জরায়ুতে ইনফেকশন এর ঝুকি এবং সম্ভাবনা কমে যাবে।
তবে প্যাড বা কাপড় ছাড়াও মেন্সটুয়াল কাপ বা টেম্পুনস ব্যাবহার করা যায় ,তবে এই দুটি খুব একটা জনপ্রিয় না । পিরিয়ডের কারনে আমাদের মেয়েদের অনেক ক্রেম্প হয় ,ব্যাথা হয় এবং মন-মেজাজের পরিবর্তন (মুড সুইং) হয় অনেক বেশি এর প্রত্যকেটির পেছনের কারন হলো লৈঙ্গিক হরমোন (ফিমেল সেক্স হরমোন)
৩) যোনি স্রাব/ vaginal discharge : বয়সন্ধিকালে আমাদের বিভিন্ন প্রজনন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পরিনত হতে থাকে । ।এর সাথে যোনী (vagina )এক প্রকার তরল পদার্থ (Fluid) নির্গত করে ,যাকে ভেজাইনাল ডিসচার্জ ( vaginal discharge) বলে ।
যোনি স্রাব (vaginal discharge ) মহিলা প্রজনন তন্ত্র এবং ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সংরক্ষন কেন্দ্র হিসেবে ( house keeping ) কাজ করে। এটি এক প্রকারের তরল যা ভেজাইনার ভিতরে বিভিন্ন ধরনের গ্রন্থি দিয়ে তৈরী হয়ে থাকে এবং সারভিক্স এর মাধ্যমে মৃত কোষ এবং ব্যাকটিরিয়াকে বাইরে বের করে নিয়ে আসে। এই বেরিয়া আসা তরল পদার্থ ভেজাইনাকে পরিষ্কার রাখে এবং রোগ জীবানু থেকে রক্ষা করে রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে।
অনেকের ভেজাইনাল ডিসচার্চ অনেক বেশি হয়ে থাকে, কারো কারো ক্ষেত্রে অনেক কম , কারো ক্ষেত্রে এই তরল খুব তরল হয় ,কারো ক্ষেত্রে খুব ঘন হয় ,অনেকটা কটেজ চিজ এর মতো। রং সাধারনত সাদা হয়ে থাকে তবে কারো ক্ষেত্রে হালকা হলুদ হয় ।কারো ভেজাইনাল ডিসচার্জ এ আবার গন্ধ থাকে ।
এই তিনটি প্রধান পরিবর্তন ছাড়াও আরো পরিবর্তন আছে যা ইতিমধ্যেই আলোচনা করা হয়েছে ।তবুও আরেকবার মনে করিয়ে দেয়ার জন্য বলছি।
- বয়সন্ধিতে মেয়েরা তাদের পেলভিক এড়িয়াতে একটু ওজন লাভ করে থাকে ,তারপর হিপ একটু ভারী হতে পারে । এই পুরো স্বাভাবিক প্রক্রিয়া অতোপ্রতোভাবে বয়ঃসন্ধিতে একটা মানুষকে একটা মেয়েতে পরিনত করে।
- শরীরের বিভিন্ন স্থানে লোম গজাতে থাকে । আর এই লোম আমাদের শরীরের তাপমত্রা মিয়ন্ত্রন করে এবং অনেক অপৃতীকর অবস্থা থেকে আমাদের রক্ষা করে ।
- এ বিষেশত বগলে ,পিউবিক এড়িয়াতে,পায়ে বেশী লোম গজাতে দেখা যায় ।বয়স বাড়ার সাথে সাথে লোমের ঘনত্ত্ব আরও বাড়তে থাকে।
- প্রজননন তন্ত্র এবং স্বাস্থ্যের অনেক পরিবর্তন শুরু হয় ।অনেকে প্রজনন অংগ-প্রত্যংগ ধীরে ধীরে পরিনত হতে থাকে। ফেলোপিয়ান টিউব ,ইঊটেরাস ,ভেজাইনা ধীরে ধীরে তার কার্যক্রম শুরু করে, হরমোন তৈরী হতে থাকে ,আর এর সাথে অনেক শারীরিক এবং মানষিক পরিবর্ত আসতে থাকে । এই যেমন – অভারিতে(ডিম্বাশয়) ডিম্বানু/এগ তৈরী হয় প্রতি মাসে ,আর এই অভারি ই হলো ফিম্যাল রিপ্রডাক্টিভ সিস্টেমের( মহিলা প্রজনন তন্ত্র) প্রধান অংগ।অভারিতে তৈরী হওয়া ডিম্বানুই শুক্রানুর সাথে শারীরিক সম্পর্কের মাধ্য মে মিলিত হয়ে জাইগোট তৈরী করে যা পরবর্তীতে একটা পরিনত সন্তান জন্ম দিতে সক্ষম ।
- ব্রন এবং পিম্পলস হতে পারে
- অনেক বেশি ঘাম এবং দুর্গন্ধ হতে থাকে
প্রজনন স্বাস্থ্য ছাড়াও আরো যেসব পরিবর্তন আসে ,সেগুলো হলোঃ
- মস্তিস্কের বিকাশ (ব্রেইন ডেভেলপমেন্ট ):
- বয়সন্ধিকালে বাচ্চাদের মস্তিস্কের বিকাশ খুব দ্রুত গতিতে হতে থাকে এবং এই প্রক্রিয়া বিশ বছর পর্যন্ত ( mid-20s) চলতেই থাকে।
- আর তাই এসময় তাদের বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা , সমস্যার সমাধান এবং সিদ্বান্ত গ্রহন এবং অংশগ্রহনের (planning, problem-solving and decision-making) সুযোগ করে দিয়ে তাদের তৈরী করা যেতে পারে, যাতে করে তারা এই সময়টাতে কর্মদক্ষ হতে শিখে এবং পরনীর্ভরশীলতা ছেড়ে নিজেদের উপর নিজেরাই নির্ভরশীল হতে পারেীতে করে তাদের আত্নবিশ্বাসও অনেক ক্ষেত্রেই বেড়ে যাবে।
- প্রজনন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ছাড়াও অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ এ সময়ে পরিনত হতে থাকে ,ধীরে ধীরে একটি মানুষের বড় হওয়ার প্রক্রিয়া এটি।
- বয়ঃসন্ধিকালে মানুষ এতো তাড়াতাড়ি বড় হতে থাকে যে তাদের সেন্টারস অব গ্রেভিটি ( centers of gravity ) খুব তাড়াতাড়ি পরিবর্তন হতে থাকে। এতে করে ব্রেইন এই নতুন পরিবেশের সাথে খাপ খায়িয়ে নিতে একটু সময় নেয় ।যার কারনে বয়সন্ধিকালে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে একটু খামখেয়ালি ভাব চলে আসে। অনেক বাচ্চারা এসময় অসাবধানতার কারনে আহত হয় বা পড়ে ব্যাথা পায় ।
- পেশী শক্তি বাড়তে থাকে এবং আকারে বড় হতে থাকে।
- এসময় ওজন নিয়ন্ত্রন করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না ।তাই পরিবারের পক্ষ থেকেই একটি সুষম খাদ্যের তালিকা তৈরী করে দেয়া উচিত ।
- অনেকের ঘুমের অভ্যাস ( স্লিপ পেটার্ন )বদলে যায় ।অনেকেই শেষ রাতের দিকে জেগে থাকে এবং দিনের বেলায় ঘুমানোর প্রবনতা দেখা যায়।এসময় পর্যাপ্ত পরিমানে ঘুম খুব দরকার ।
Recent Comments