আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলে গিয়েছেন ,“বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর” । নারী জাগরনের এই পথ প্রতিক্রমায় আমরা অনেক দূর পাড়ি দিয়েছি । সৃস্টি করেছি অনেক  গৌরবের মর্যাদাপূর্ন কিছু অধ্যায়, যা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে করেছে আরো শক্তিশালী ,সভ্যতাকে দিয়েছে সমৃদ্ধি এবং বাংলাদেশের নামকে  বিশ্ব দরবারে করেছে অধিক সমাধৃত। নারীদের এই চলার পথ বাংলাদেশে কখনোই এতোটা সহজ ছিলো না ,এখনো সহজ না । লড়াইয়ের এই চলার পথে নারীদের কখনো থামতে হয়েছে সমাজের অযাচিত প্রশ্নের মুখে ,কখনোবা পরিবারের চাপের মুখে , তবুও নারীরা এগিয়ে যান ,যেতে হয় ।

নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন এবং সেই সাথে  বাংলাদেশকেও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন , এরকম  হাজার গল্পের সাথে আমরা সবাই কম বেশি  পরিচিত। মুদ্রার এক পিঠে যখন নারীদের অনেক সাফল্য গাথা রচিত হয় ,মুদ্রার ঠিক অপর পিঠে ঠিক হয় “মেয়েরা শাস্তি , নাকি স্বস্তি”।  দুঃখজনক হলেও সত্যি ,বাংলাদেশে এখনো অনেক পরিবার আছে ,যারা মেয়ে সন্তান এর  জন্ম গ্রহন কে শাস্তি মনে করে থাকেন ,তাই তাড়াতাড়ি স্বস্থি পাওয়ার জন্য মেয়েদেরকে পড়াশোনা না করিয়ে  কম বয়সেই বিয়ে দিয়ে দেন। তাই মেয়ে সন্তান শাস্তি এবং স্বস্থির প্রতীক কারো কারো জন্য।

এখনো অনেক পরিবারে মেয়ে সন্তান জন্ম গ্রহন করলে, স্ত্রীর প্রতি অত্যাচার করা হয় ,অথচ বিজ্ঞান বলে মেয়ে সন্তান জন্মের জন্য একজন পুরুষই একমাত্র দায়ী ,কোনোভাবেই একজন নারী এর জন্য দায়ী নয়। যেহেতু “চায়ের দেশ” একটি  স্থানীয় পত্রিকা ,তাই আমি সারা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারী অগযাত্রায় বাধার কারন সমূহ বিচার  বিশ্লেষন না করে ,শুধু সিলেটের প্রেক্ষাপটে লিখার চেস্টা করছি । খারাপ লাগলেও মানতে হবে ,বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে সিলেটের মেয়েরা শিক্ষাদীক্ষায় অনেক পিছিয়ে আছে ।

 

আমি প্রথম যখন ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম ,সবাই প্রশ্ন করতেন গ্রামের বাড়ি কোথায়  । আমি সিলেটের মেয়ে শুনলে অনেকেই মন্তব্য করে বসতেন , “ও আচ্ছা ,লন্ডনী। তুমি তো লন্ডন চলে যাবে ,তোমার কি লন্ডনে বিয়ে ঠিক”। আর এখন যখন জার্মানীতে স্নাতোকোত্তর করতে আসলাম ,অনেকেই সিলেটি শুনে বলেন , “লন্ডন না গিয়ে জার্মানী আসলে কিভাবে”। যারা এই অবান্তর প্রশ্ন করেন ,তাদের কথাকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই ,কারন আমরা সিলেটিরা মানষিকতার দিক থেকে এখনো  অনেকটা  পিছিয়ে আছি ,সবাই না , তবে মেয়েদের বেলায় পরিবারের উদাসীনতা অনেক বেশি দেখা যায়। যারা লন্ডনে থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনেক গুরুত্ব পূর্ন অবদান রেখে চলেছেন,তাদের প্রতি পূর্ন শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, আআমদের সিলেটে অনেক পরিবার আছেন , যারা  নিজের মেয়ের পড়াশোনার জন্য খরচ করতে নারাজ ,কিন্তু লক্ষ্য লক্ষ্য টাকা খরচ করে মেয়েকে কম বয়সে সাবলম্বী না বানিয়ে ঠিকই বিয়ে দিয়ে দেন। এর পেছনে অনেক পরিবারের যুক্তি এরকম থাকে  যে , “মেয়েদের এতো টাকা খরচ করে  পড়াশোনা করিয়ে কি হবে ,বিয়ে হলে তো শ্বশুড় বাড়ি চলে যাবে , তখন তো বাবার পরিবারে অবদান রাখতে পারবেনা ”।

অবশ্যই আমি বিয়ের বিরুদ্ধে না , তবে মেয়েদের পড়াশোনার সুযোগ সুবিধা না করে দিয়ে , কম বয়সে  বিয়ে দেয়ার বিপক্ষে। আমি তাদের ও বিরোধিতা করছি ,যারা ছেলে লন্ডন থাকে শুনলেই এক সেকেন্ডও দেড়ি না করে ,মেয়েকে কম বয়সে বিয়ে দিয়ে তাকে পঙ্গু বানিয়ে দিচ্ছেন। হ্যা ,বিয়ের পরও অনেক মেয়ে পড়াশোনা করে সাবলম্বী হয়েছে এমন অনেক উদাহরন আছে ,তবে লন্ডন শুনেই পাগল হয়ে বিয়ে দিয়ে দেয়া বেশির ভাগ মেয়েরাই মানষিক নির্যাতনের স্বীকার এবং অনেকেই অনেক মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এটি আমার কথা না ,খুব সম্প্রতি লন্ডনের  একটি সরকারী সংস্থার গবেষনায় এসেছে ,সেখানে বিবাহিত বাংলাদেশী মেয়েদের শতকরা আশি ভাগই মানষিক এবং শারীরিক নির্যাতনের স্বীকার এবং তাদের অধিকাংশই সিলেটের মেয়ে, যাদের অনেক কম বয়সে পরিবার থেকেই  বিয়ে দিয়ে দেয়া  হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকেই মিডিয়াতে ইন্টারভিউ দিয়েছেন ,যেখানে উনারা বলেছেন , “ বিয়ের পর লন্ডন আসার পর স্বামী এবং তার পরিবারের অন্য রকম চেহার দেখেছি ,নিজের পরিবারের কাছ থেকে সহায়তা পাইনি ,পরিবারের সবাই শুধু  মানিয়ে নিতে বলেন ,কখনো সন্তানের দোহাই দিয়ে ,কখনো সমাজের দোহাই দিয়ে”।

আর আমি বলি , “ আমাদের গড় আয়ূ কিন্তু খুব বেশি না ,বাচবোইবা  কতদিন ,এভাবে সবাইকে খুশি করতে গিয়ে আমাদের মেয়েদের আত্নার অপমৃত্যু ঠেকানোর দায়িত্ত্ব কার? আমার পরিবারের নয় কী? আমি কি নিজের ইচ্ছায় এই পৃথিবীতে এসেছি” ?

সমাজকে দোষ দিবো না ,কারন আমি আপনি মিলেই সমাজ গঠিত হয়। আপনি যখন আপনার মানষিকতা বদলাবেন ,নিজের মেয়েকে সঠিক শিক্ষার ব্যাবস্থা করে দিবেন ,তখন আপনার পরিবার থেকে শুরু করে সমগ্র দেশের  আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি হবে। বিয়ের জন্য সঠিক কোনো বয়স নেই ,যখন কেউ সঠিক একটি  মানুষের দেখা পায় ,তখনই সেটা তার জন্য সঠিক বিয়ের সময় হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবতা সম্পুর্ন ভিন্ন । একটা মেয়েকে সব সময় বয়স নিয়ে কথা শুনিয়ে থামিয়ে দেয়ার চেস্টা করা হয় ,বয়স বেশি হয়ে যাবে এই ভ্রান্ত ধারনায় উদ্দীপিত হয়ে অনেক পরিবার তাড়াহুড়ো করে নিজের মেয়েকে বিয়ে দিয়ে থাকেন ,তারপর কেউ সুখী হয় ,কেউ অসুখী হয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দেয় । এই বেচে থেকেও মরে যাবার চিত্র আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না , আসলে দেখা যায় না ।

তাই আপনাদের যাদের মেয়ে আছে,তাকে মেয়ে না ভেবে মানুষ ভাবতে শিখুন। তাকে ছোটবেলা থেকে   শিখিয়ে তুলুন , “সবার প্রথমে তুমি একজন মানুষ ।তারপর তুমি একটি মেয়ে ,তোমার  এই বায়োলজিক্যাল পরিচয় সব জায়গায় দরকার হবেনা , তুমি যদি ঠিকমতো পড়াশোনা করো, নিজেকে গড়ে তোলো ,অন্য মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল হও ,নিজের দেশের জন্য কাজ করো ,তাহলে তুমিও একটি ছেলের মত নিজের এবং নিজের পরিবারের দায়িত্ত্ব নিতে পারবে” । কারন পরিবার থেকেই সবার প্রথমে  নারী-পুরুষের এই  বৈষম্যের সূচনা হয় । ছোটবেলাতেই পরিবারের বড়রা তার মেয়েকে খেলনা সামগ্রী হিসেবে রান্না ঘরের হাড়িপাতিল এবং ছেলেদেরকে উড়োজাহাজ , গাড়ি, ভিডিও গেম  জাতীয় সামগ্রী কিনে দিয়ে থাকেন। আর এভাবেই আমাদের চিন্তা-শক্তিকে সীমিত করে দেয়া হয়। কেনো? একটি মেয়েকি পাইলট হতে পারেনা? একটি ছেলে কি ভালো বাবুর্চি হতে পারেনা? অবশ্যই পারে ,আশেপাশে এরকম হাজারো সাফল্যগাথা আছে । তবে আশার কথা হলো এই যে ,আমাদের শ্রীমংলের বেশির ভাগ  মা-বাবারা মেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারে অনেক সচেতন ,শ্রীমংলের মেয়েরা সিলেটের অন্যান্য এলাকার চেয়ে অনেক এগিয়ে যাচ্ছে ,কিন্তু শ্রীমংগল তো সিলেটেরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই দায় আমরা কোনভাবেই এড়িয়ে যেতে পারিনা ,যেখানে শ্রীমংগল মৌলভীবাজারের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং যেখানে মেয়েদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কম বয়সে লন্ডন প্রবাসীদের কাছে বিয়ে দেয়ার জন্য নীরব প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। আর লোক দেখানো এই বিয়ে নামক অসুস্থ সামাজিক প্রতিযোগিতায় ,আমরা অন্য পরিবারের জন্য অনেক বাধার সৃস্টি করে দিচ্ছি। কেননা ,অনেক পরিবারের সামর্থ না থাকা সত্ত্বেও এসব সামাজীকতা রক্ষা করতে গিয়ে ,অনেক কস্ট করে ধুমধাম করে বিয়ে দেয়ার এবং কনের সাথে অনেক পন্যসামগ্রী অথবা যৌতুক দিয়ে দেয়ার প্রথাকে আমরা বাধ্যতামূলক এবং কঠিন করি তুলছি ।বিয়ের মতো একটি পবিত্র বন্ধন এসবের উর্ধে হওয়া উচিত ছিলো। আর  বিত্তবানদের এসব বাধ্য হয়ে পালন করা লোক দেখানো  সামাজিক প্রথা অন্য পরিবারের কস্টের কারন হওয়াটাও যথেষ্ট  যুক্তিযুক্ত না ।

 

শেষ করবো সব বাবা-মায়েদের দৃস্টি আকর্ষন করে ।“ফেমিনিজম” অথবা নারীদের সমঅধিকারের আন্দোলনকে সমর্থন জানানো মানে কোনো অবস্থাতেই  “পুরুষকে ঘৃনা করা  অথবা  পুরুষশাষিত সমাজের বিরোধীতা করা না ”। আমার কাছে “ফেমিনিজম” মানে হলো “আমার ভাই আমার পরিবার/সমাজ থেকে যেসব সুযোগসুবিধা পাবে ,আমিও ঠিক সেসব   সুযোগ সুবিধা  সমানভাবে পাবো ”। আর এটাই ফেমিনিজমের সৌন্দর্য এবং সার্থকতা । আপনি আপনার মেয়েকে একটি মুক্ত পাখির মত খোলা আকাশে উড়তে দিন ,দিন শেষে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষ্যা করে পাখি ঠিকই নীড়ে ফিরে আসবে। মেয়েকে বিশ্বাস করে স্বাধীনতা দিন, মানুষ হয়ে নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে বাচতে শিখান ,সুশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ করে   দিন । দিন শেষে আপনিই নীরবে জিতে যাবেন ।