মেয়েদের মাসিক ( পিরিয়ড/ মেন্সট্রুয়েশন )  নিয়ে মনে হয় সবচেয়ে বেশি লুকোচুরি খেলা হয় আমাদের সমাজে  । ছোটোবেলা থেকে বেশির ভাগ মেয়েদের শিখানো হয় ‘মাসিক হলে ছেলেদের সামনে বলবেনা  , ”রোজা ভাংলে সবার সামনে খাবেনা” , ”কাউকে বুঝতে দিবেনা ”, ”স্যানিটারি প্যাড লুকিয়ে রাখবে যাতে  পরিবারের ছেলেরা  না দেখতে পারে ”। আবার এমন অনেকেই আছে যারা রোজার সময় স্কুল/কলেজ/ভার্সিটিতে এসে সারাদিন না খেয়ে থাকবে,যদি ছেলে বন্ধুরা  দেখে তাহলে হাসাহাসি করবে ।  এমনকি  পানি খেলেও লুকিয়ে খেতে হবে ।রোজাদারদের সামনে খাওয়া উচিত না ,সেটা আলাদা কথা এবং  অবশ্যই এটা মানা উচিত কিন্তু মাসিকের সময় না খেয়ে থাকা প্রজনন স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর যা আমাদের মানষিক স্বাস্থ্যকেও বিঘ্নিত করে।

আর  যেসব  খুব কম সংখ্যক মেয়েরা  মাসিক নিয়ে খোলামেলা   কথা বলতে পারে অথবা কেউ যদি প্রশ্ন  করে ‘মন ভালো না কেনো , মেজাজ খারাপ কেনো’  অথবা ‘কেনো পেটে ব্যাথা  হচ্ছে’ এর উত্তরে যদি বলে মাসিক  হয়েছে তাহলেও অনেক অপ্রত্যাশিত  পরিবেশের সৃষ্টি হয় ।পাশের মেয়ে বন্ধুরা  অকারনেই লজ্জ্বা পায় আর  ছেলে বন্ধুদের কেউ কেউ হয়তো  চুপিচুপি হাসে অথবা  কেউ আবার মেয়েটার সম্পর্কে ভুল বুঝে ,আজে-বাজে মন্তব্য করে । আশেপাশের পরিবেশ থেকে মাসিকের সময়টাতেই  একটা মেয়ের সবচেয়ে বেশি মানষিকভাবে সহযোগিতা প্রয়োজন কিন্তু এই সময়েই একটা মেয়েকে অনেক বেশি বিব্রতকর পরিবেশের সাথে পরিচিত হতে হয় ,আর এভাবেই মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

 

এমনকি একটা ছোট ছেলে/মেয়ে যখন পরিবারের মানুষকে টিভিতে  স্যানিটারি প্যাড এর বিজ্ঞাপন  দেখে প্রশ্ন  করে , তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা  ‘এটা বড়দের ব্যাপার,তোমার বোঝার বয়স হয়নি বলে এড়িয়ে যায়’ ।আর আমাদের  সবচেয়ে বড় ভুলটা এখানেই।বাচ্চারা অনেক বেশি কৌতুহলী হয় ।তারা যখন পরিবারে কাছ থেকে এসব ব্যাপারে  জানতে না পারে ,তখন বন্ধুদের সাথে এটা নিয়ে কথা বলে এবং  ভুল তথ্য জানে । আর এখন তো ইন্টারনেটে হাতের মুঠোয়। আর তাই  অনেক সময় এই বাচ্চা ছেলে-মেয়েগুলো নেট এ ভুলে ভরা বাংলা ভিডিও দেখে । সঠিক  তথ্যের অভাবে অনেক  ভুল ভিন্তা ভাবনায় দিক্ষীত হয়  । বাংলা ভিডিওর কথা  বলছি কারন  ইন্টারনেটে সার্চ দেয়ার আগেই এইসব আজেবাজে ছবি দিয়ে তৈরী করা ভিডিও  সবার আগে চলে আসে যেখানে অনেক বাজেভাবে তথ্য দেয়া থাকে এবং যার বিজ্জ্বানসম্মত কোনো ভিত্তি নেই  ।আর ইন্টারনেটে যেসব তথ্যবহুল বিজ্জ্বানসম্মত  ভিডিও দেয়া থাকে,  সেসব  অনেক সময় বড়দের জন্যও বোঝাটা কস্টকর হয়ে যায়আর সে ক্ষেত্রে ছোটদের তো উৎসাহ না জাগারই কথা ।

দুঃখজনক হলেও সত্যি যে বাংলাদেশের  বেশির ভাগ পরিবারের চিত্র ঠিক এমনটাই- পরিবারের ছোটদের সাথে তাদের শারীরিক এবং  মানষিক পরিবর্তন নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা হয় না । পরিবার  থেকে  যদি গল্পের  মত করে ছোটদের  শেখানো না শুরু হয়,তাহলে  এই  মাসিক/পিরিয়ড নিয়ে লজ্জ্বা পাওয়ার লুকোচুরি গল্প চলতেই থাকবে । এতে করে একটি মেয়ে কখনোই তার মাসিক চলাকালীন সময়ে মানষিক ভাবে আশেপাশের সবার কাছ থেকে সহযোগীতা পাবেনা ।

 

তারপর আবার অনেকেসময়   সুপারশপ অথবা ফার্মেসীগুলোতে মেয়েরা  প্যাড কিনতে  গেলে অনেক  লজ্জ্বা পায় এবং যারা বিক্রি করে তারাও লুকিয়ে লুকিয়ে হাসে । যেনো এটা খুবই অস্বাভাবিক এবং লজ্জ্বার ব্যাপার । এর পেছনে  আমাদের ত্রুটিপূর্ন  শিক্ষা ব্যাবস্থা একটু হলে ও দায়ী।   সিলেবাসে মাসিক নিয়ে চ্যাপ্টার থাকলেও সেই অর্থে  খোলামেলা ভাবে পড়ানো হয়না । আর  শহরের  স্কুল-কলেজে পড়ানো   হলেও গ্রামের চিত্র একটু ভিন্ন । আবার অনেক ক্ষেত্রে ছেলে মেয়েদের আলাদা করে এসব বিষয়ে ক্লাসে পাথদান করা হয় ,এটা কোনো অবস্থাতেই হওয়া উচিত না  আর সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে সেক্স এডুকেশন,আমাদের শারীরিক পরিবর্তন  এবং মানষিক স্বাস্থ্য নিয়ে  এখনো   আমাদের দেশে   বিজ্ঞানসম্মত খোলামেলা আলোচনা হয় না ,তাই আমাদের সমাজে অনেক কুসংস্কার আছে ,যা আমাদের বয়ঃসন্ধিকাল থেকে শুরু করে জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই মানষিক স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে ।

আর তাই একটি মেয়েকে যেমন মাসিক নিয়ে লজ্জ্বা না পাওয়ার কারন জানাতে হবে যাতে করে সে আত্নবিশ্বাসীর সাথে এগিয়ে যেতে পারে  ,ঠিক তেমনি একটি ছেলেকেও বোঝাতে হবে ,মাসিক বেড়ে উঠার প্রক্রিয়ায় খুব  স্বাভাবিক একটি বিজ্ঞানসম্মত ধাপ, বরং এটা নিয়ে হাসি ঠাট্টা না করে   ঠিক এই সময়টাতে  মেয়েদেরকে শারীরিক এবং মানষিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য  একটি সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। আর পরিবারের ছোটদের কে এসব ব্যাপারে সুন্দর করে বুঝিয়ে বললে তারা এটা নিয়ে ভুল ধারনা পোষন করে অহেতুক কৌতুহলী হবে না  এবং ইন্টারনেট অথবা  বন্ধুদের কাছ থেকে ভুল তথ্য  জানবেনা না।

 

এবার আসুন এক নজরে জেনে নেই কেনো আমাদের মাসিক নিয়ে লজ্জা পাওয়া উচিত না :

  • মাসিকের সাথে মাতৃত্ত্বের খুবই গুরুত্ত্বপূর্ন যোগসূত্র রয়েছে।
  • নারীদের রিপ্রডাক্টিভ সিস্টেমের  এর  প্রধান অংগ  হল অভারি (Ovary) এবং প্রত্যেকের দুইটি অভারি থাকে যা ফিম্যাল হরমোন  উৎপাদন  করে ।
  • আর অভারিতে যে ফলিকল থাকে তা ডিম্বানু(অভাম /এগ) তৈরী করে । প্রত্যেক মাসে একটা পরিনত ডিম্বানু/এগ ইউটেরাইন টিউব অথবা ফেলোপিয়ান টিউবে প্রবেশ করে এবং ইঊটেরাসে প্রবেশ করে এবং প্রত্যেক মাসে এন্ডোমেট্রিয়াম(ইঊটেরাসের লাইনিং ) ব্লাড এবং ফ্লুইড দ্বারা পরিপক্ক্ব হয় ।
  • এতে করে যে ডিম্বানু তৈরী হয়,তার মধ্য থেকে পরিপক্ক ডিম্বানুকে আলাদা করার জন্য এই এন্ডোমেট্রিয়াম ছাকনি হিসেবে কাজ করে ।আর যদি ডিম্বানু পরিপক্ক্ব  না হয় তাহলে এটা ইঊটেরাসের এর মধ্য দিয়ে লাইনিং এর মাধ্যমে  বের হয়ে আসে। এই বের হয়ে আসাটাকেই ডিসচার্জ  বলে এবং এই প্রত্যেক মাসের ডিসচার্জকেই  মাসিক বলে থাকি ।
  • আবার ইঊটেরাস সংযুক্ত থাকে ভ্যাজাইনার  এর সাথে, সারভিক্স  এর মাধ্যমে। সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্সের সময় পুরুষের শুক্রানু (স্পার্ম) ফেলোপিয়ান টিউব  এ প্রবেশ করে ডিম্বানুকে পরিপক্ক্ব করার জন্য । আর এই ডিম্বানু এবং শুক্রানু এর জেনেটিক মেটারিয়াল একসাথে মিশে জাইগোট তৈরী করে ।
  • তারপর এই জাইগোট থেকেই ধীরে ধীরে একটা বাচ্চা  পরিনত হতে থাকে ।সম্পুর্ন প্রক্রিয়াকে বলে অভ্যুলোশন  এবং ার  মাসিক  হচ্ছে মাতৃত্বের  একটা ধনাত্ত্বক চিহ্ন। সহজ ভাষায় ডিম্বানু   তৈরী না হলে মাসিকের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ হবে এবং মাতৃত্বের সম্পুর্ন প্রক্রিয়া সফল ভাবে সম্পন্ন হবে না ।

মাতৃত্ত্ব নিয়ে আমাদের মধ্যে এতো গর্ব , এতো অহংকার ,তাহলে মাসিক নিয়ে কেনো এতো লজ্জ্বা ?

তাই সময় এসেছে নিজে জানার এবং অপরকে জানানোর  ।

অবশ্যই আমরা করবো জয় -লজ্জ্বাকে করবো জয়, ভয়কে করবো  জয় ………

জয়ের এই শোভাযাত্রায় আমাদের চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন হোক , শুরু হোক  নতুন এক অধ্যায়ের।