আমাদের হাত পা কেটে গেলে, শরীরের কোনো জায়গায় ব্যাথা অনুভব করলে   অথবা আহত হলে আমরা ডাক্তারের কাছে যাই ,ঔষধ খেয়ে থাকি  এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহন করি । কিন্তু আমাদের মনের স্বাস্থ্য যখন ক্ষতিগ্রস্থ হয়, আমরা কি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারি? আশেপাশের পরিবেশ থেকে কি সহযোগীতা পাই? নিজের মনকে বোঝা চেষ্টা করি? বড়রা কি আমাদের বোঝতে পারেন?এসব প্রশ্নের উত্তর অবশ্যই “না”। কারন আমাদের সমাজ ব্যাবস্থায় মানষিক স্বাস্থ্যকে অবহেলা করা হয় ।  স্বাস্থ্য মানে শারীরিক এবং মানষিক স্বাস্থ্যের সমন্নয় কিন্তু আমরা যেরকম  মনের স্বাস্থ্যের   যত্ন   নেবার জন্য আশেপাশের পরিবেশ থেকে যথেষ্ট উপাদান পাই না , ঠিক তেমনি আমাদের বয়ঃজেষ্ঠ্ররাও কিশোর-কিশোরীদের সাথে মানিয়ে নিতে পারেন না অনেক ক্ষেত্রেই। আর এর ফলে অনেকেই বিষন্নতা সহ অনেক মানষিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগছেন ।

(Published in the weekly chayeer desh ,Sreemangal,Moulvibajar)

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক রিপোর্টে বলা হয়েছে ,সারা বিশ্বে  প্রায় ত্রিশ কোটিরও বেশি মানুষ বিষন্নতায় ভোগছেন ।ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অফ মেন্টাল হ্যালথ এর রিপোর্টে বলা হয়েছে কর্মস্থলে প্রতি পাচজনের একজন মানষিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত । এদের মধ্যে আমাদের দেশে অনেক কিশোর-কিশোরীরা আছে যার হার দুইহাজার ষোল সালের কমিউনিটি জরীপ এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী বেড়ে দাড়িয়েছে ৩2 শতাংশ । হাত কাটলে রক্ত পড়ে ,দেখা যায় ,ব্যাথা পাই কিন্তু মানষিক স্বাস্থ্যের কোনো উপসর্গ নেই তাই আমরা একে অবহেলা করি। মন খারাপ হওয়া আর বিষন্নতা   (ডিপ্রেশন) সম্পুর্ন আলাদা জিনিস।  অনেক প্রকার মানষিক অসুখের মধ্যে ডিপ্রেশন অন্যতম প্রধান অসুখ , যা এখন কার উঠতি বয়সী  কিশোর কিশোরীদের মধ্যে বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে ,এর চিকিৎসা অবশ্যই জরূরী।

বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর কিশোরীরা একটু এলোমেলো থাকে ।শারীরিক পরিবর্তনের সাথে তাদের  অনেক মানষিক পরিবর্তনও আসে। এই সময়ে তাদের মধ্যে ভুল করার প্রবনতা থাকে । নতুন অনেক কিছুর প্রতি অনেক আকর্ষন তৈরী হয় ।কেউ অনেক অনৈতিক কাজের সাথে জড়িয়ে পড়ে, কেঊ শিক্ষা ব্যাবস্থার সাথ খাপ খায়িয়ে নিতে পারেনা ,কেউ সমাজ ব্যাবস্থার অনেক উপাদানে নিজের চলার পথকে বিঘ্নিত করে, কেউ পারিবারিক ভাবে সুখী না । কিশোর -কিশোরীদের এতো পরিবর্তনের সময় তাদের প্রয়োজন ভালোবাসা, সহযোগীতা এবং সহমর্মিতা । যেহেতু আমি মানষিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছি , বেশির ভাগ সময় আমার রিসার্চের রিপোর্ট এমন আসে ,যেখানে উঠতি বয়ঃসী ছেলে মেয়েরা বলে “আমার মা-বাবা আমাকে বোঝেনা ,শিক্ষকরা শুধু বকা দেন ” ।অন্যদিকে মা-বাবারা বলেন , “ছেলে মেয়েরা কথা শুনে না”। শিক্ষকরা বলেন , “ ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ন্ত্রন করা যায় না”। আমি বলব কারো কথাই সম্পূর্ন  সঠিক না । এটা  জেনারেশন গ্যাপ । অনেক বছর আগে ,আমাদের দেশ এতো প্রযুক্তি নির্ভর ছিলোনা। এখন ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারনে সারাবিশ্ব উঠতি বয়সী ছেলে মেয়েদের হাতের মুঠোয়। । আপনি হয়তো চিন্তা করছেন , আপনার সন্তান বইবেলা থেকে বই কিনে পড়বে ,কিন্তু আপনার সন্তান হয়তো ইন্টারনেট থেকে ডাইনলোড করে মোবাইলে ই-বুক পড়বে । আবার আপনি হয়তো চিন্তা করবেন ,আপনার সন্তান পৃথীবীর ইতিহাস বই পড়ে জানবে ,কিন্তু আপনার সন্তান হয়তো ইন্টারনেট এর মাধ্যমে ইঊটিউবে অনেক শিক্ষা্মূলক উপকরন দেখে নিচ্ছে। তাই আমাদের বড়দের যেরকম এই পরিবর্তনকে স্বাগতম জানিয়ে ছেলে মেয়েদের সাথে বন্ধু সুলভ আচরন করতে হবে ,তাদের ভালো কাজের প্রশংসা সবার সামনে করতে হবে এবং ভুল করলে সবার আড়ালে তাদের ভুল শুধরে দিতে হবে , ঠিক তেমনি ঊঠতি বয়সী ছেলে মেয়েদেরকেও বড়দের প্রতি পূর্ন শ্রদ্ধা দেখিয়ে তাদের সাথে নির্ভয়ে নিজের মতামত জানাতে হবে । মতের অমিল মানে মতের বিরোধীতা করা না ,বরং ভিন্নমতকে সম্মান জানানোই ঐক্যমত। তাই আপনার সন্তান অথবা শিক্ষার্থী ভুল করলে ,তাকে সবার সামনে অপমান না করে তাকে বোঝান। আপনার এমন কোনো আচরন যেনো তার মানষিক স্বাস্থ্যকে বিঘ্নিত না করে সে দায়িত্ত্ব আমার ,আপনার , আমাদের সবার । আজকের কিশোর-কিশরীরাই আগামীর বাংলাদেশকে নেতৃত্ত্ব দিবে । তাই সুন্দর বাংলাদেশ বিনির্মানে আপনার সন্তান ,আপনার শিক্ষার্থীর মনে কথা শুনুন ,তাদেরকে বুঝার চেস্টা করুন ,আড়ালে তাদের সমস্যার কথা শুনুন, তারা ভুল করলে বাসায় বিচার না দিয়ে তাদের সাথে আগে  কথা বলুন  এবং তাদের মা-বাবাকে বুঝিয়ে বলুন, ,অন্যের ছেলে-মেয়ে ভুল করলে সাথে সাথে সবাইকে না জানিয়ে চুপ থাকুন , কারো সমালোচনা করলে দায়িত্ত্বের সাথে গঠনমূলক সমালোচনা করুন ,ছেলে-মেয়েদের ভয় ভীতি না দেখিয়ে তাদের সাথে ভালো ব্যাবহার করুন ।এসব কিছুকে “কাউন্সিলিং “ বলে। যেহেতু আমাদের দেশে বিষন্নতায় ভোগলে সাইকোলজিস্ট এর কাছে গেলে সবাই পাগল ভাবে ,তাই আপনার সন্তানের কাউন্সিলিং এর দায়িত্ত্ব আপনাকেই নিতে হবে। বাইরের মানুষের কথা শুনে আপনার সন্তানকে বকাঝকা না করে তার কথা শুনুন এবং তার ভুল ধরিয়ে দিয়ে তার পথচলা এবং পড়াশোনাকে আরো সহজতর করে তুলুন । শুধু স্কুলে পাঠানো  এবং টাকা দিলেই মা-বাবার দায়িত্ত্ব শেষ হয়ে যায় না , আমাদের অবশ্যই এই প্রযুক্তির পরিবর্তন মেনে নিয়ে কিশোর-কিশীরীদের মানষিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।  প্রযুক্তির খারাপ ব্যাবহারে তাদের অবহিত করে নিরুৎসাহিত করুন ,ভালো কাজ করতে উৎসাহিত করুন ,বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রমে তাদের জড়িত করুন ,পড়াশোনার চাপে তারা যাতে নিজেদের মানিয়ে নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখুন।

আপনার আমার দায়িত্ত্বশীল আচরন এবং সহমর্মিতা পারেই একটি উঠতি বয়সী ছেলে অথবা মেয়েকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে । কারন বয়ঃসন্ধিকালে আমাদের অনেক হরমোনাল পরিবর্তন হয় ,এর ফলে আমাদের শারীরিক পরিবর্তনের সাথে সাথে মানষিক পরিবর্তন আসে। এতো পরিবর্তনের মাঝে আমরা যদি তাদের সাথে বিরূপ আচরন করি ,তাদের ভুল শুধরে দেয়ার চেয়া না করে তাদের সাথে খারাপ ব্যাবহার করি ,তাহলে তাদের মনের অবস্থাটা কেমন  হয় আমরা কি বুঝতে পারি? এসব পরিস্থিতি আমরা তৈরী করি বলেই আত্নহত্যা ,মাদক সহ আরো এমন অনেক অনৈতিক কাজ দিন দিন বেড়েই চলছে। আসুন আমরা সবাই সবার প্রতি দায়িত্ত্বশীল আচরন করি, মানষিক স্বাস্থ্য নিয়ে জনসম্মুখে  কথা বলি, সন্তানের বন্ধু হই  এবং জেনারেশন গ্যাপ এর কারনে তৈরী হওয়া পরিবর্তনকে সাধুবাদ জানাই।