যখন “গর্ভপাত” শব্দটি শুনেন, তখন  আপনার মনের মধ্যে কেমন অনুভূতি হয়? মুদ্রার এক পিঠ বলে যে এটি প্রত্যেকটি মেয়ের অধিকার এবং একই মুদ্রার অন্য পিঠ বিপরীত  কথা বলে  – কারন কিছু মেয়েদের জন্য, এটি যথেষ্ট ভীতিকর এবং আপত্তিকর। অবিবাহিত বয়স্কদের একটি বড় দল আছেন বাংলাদেশে, যারা যৌন সক্রিয় কিন্তু তাদের প্রজনন স্বাস্থ্য অসংরক্ষিত আছে সঠিক বিজ্ঞানম্মত তথ্যের অভাবে, সামাজিক কুসংস্কার এবং বাধার কারনে। এই যৌন সক্রিয় অবিবাহিত গ্রুপের জন্য দরকার প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা,নিরাপদ গর্ভপাতের অধিকার ,পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক জ্ঞান , বন্ধ্যাত্ব ব্যাবস্থাপনা এবং প্রজনন–অংগপ্রত্যংগ বিষয়ক সঠিক তথ্য এবং সচেতনতা। যেখানে বাধা থাকে , সুস্পষ্ঠ আলোচনার বদলে অন্ধকারের হাতছানি থাকে, বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যার পরিবর্তে অনেক প্রচলিত সামাজিক কুসংস্কার থাকে ,যেখানে ‘অধিকার সংরক্ষন’ অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ। আর স্বাস্থ্যগত অধিকারের কথা যদি বলি ,তাহলে আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশের অনেক বড় একটা চ্যালেঞ্জ হলো ‘অনিরাপদ গর্ভপাত’ কে মোকাবিলা করা। সামাজিক অনেক বাধার কারনে গর্ভাপাতের সার্ভিসগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত না ,এতে করে অনেকেই অদক্ষ এবং অপেশাদার অথবা অনুন্নত/অনুনোমদিত চিকিৎসা কেন্দ্রে গিয়ে গর্ভপাত করিয়ে থাকেন ,যা প্রজনন স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ঝুকিপূর্ন। উন্নত দেশগুলোতে গর্ভপাতকে অনোমোদন দেয়া হলেও ,আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এখনো গর্ভপাত নিয়ে অনেক কুসংস্কার আছে, নিরাপদ গর্ভপাতের সুযোগ সুবিধার অনেক অভাব আছে। আর সব সার্ভিসগুলো যখন শুধু বিবাহিততের জন্য প্রযোজ্য করে রাখা হয়েছে ,সেক্ষেত্রে অনেক অবিবাহিতরা বাধ্য হয়ে অনিরাপ গর্ভপাতের শিকার হচ্ছেন ,এর ফলে প্রজনন স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে, অক্ষমতার শিকার হচ্ছেন,মাতৃত্ত্ব হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে, এমনকি  অনেকেই মৃত্যুবরন করছেন। প্রতিবছর সারাবিশ্বে বাইশ মিলিয়ন অনিরাপদ গর্ভপাত হচ্ছে ,তবে অনুন্নত  এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোই সবচেয়ে বেশি ঝুকিতে আছে। অনিরাপদ গর্ভপাতের কারনে মেয়েদের প্রজনন স্বাস্থ্য ঝুকিগ্রস্থ হয়ে পড়ছে । গত দুই দশকে, নিরাপদ গর্ভপাত  প্রদানের জন্য মানবাধিকার সংস্থাগুলো  একাধারে কাজ করে যাচ্ছে। এই অগ্রগতি সত্ত্বেও, আনুমানিক ২২ মিলিয়ন গর্ভপাত প্রতি বছর অসফলভাবে সঞ্চালিত হচ্ছে, যার ফলে আনুমানিক 47 মিলিয়ন নারী এবং 5 মিলিয়ন নারী অক্ষমতার  শিকার হচ্ছেন ,এমনকি মৃত্যুর মত ঘটনা ঘটেছে।  এই মৃত্যু এবং প্রতিবন্ধকতাকে প্রতিরোধ করা যেতে পারে   যৌনতা শিক্ষা, পারিবারিক পরিকল্পনা, এবং নিরাপদ, আইনী প্ররোচিত গর্ভপাত এবং গর্ভপাতের জটিলতার  বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি করে । প্রায় সব উন্নত দেশে  নিরাপদ গর্ভপাত সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তিতে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। দেশে যেখানে গর্ভপাত করা আইনত অত্যন্ত সীমিত এবং / অথবা অনুপলব্ধ, নিরাপদ গর্ভপাত অনেকটাই সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাধা হয়ে উঠেছে, আর যারা সমাজে একটু নিম্নবিত্ত তাদের জন্য নিরাপদ গর্ভপাত অন এক্টাই বিলাসিতার সমান হয়ে পড়েছে। নিরাপদ গর্ভপাত পদ্ধতি: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লুএইচও) গর্ভধারণের সাথে  নিরাপদ গর্ভপাতের তিনটি পদ্ধতির সুপারিশ করে। এইগুলো:
  1. মেডিকেল গর্ভপাত (এমএ),
  2. ম্যানুয়াল ভ্যাকুয়াম এস্পিরেশন (এমভিএ)
  3. Dilatation এবং evacuation

১। মেডিকেল গর্ভপাত: মেডিকেল গর্ভপাত করানো হয় মুলত  mifepristone এবং  misoprostol বড়ি, অথবা misoprostol বড়ি একা ব্যবহার এর মাধ্যমে। এই গর্ভপাত পদ্ধতি গর্ভাবস্থার 24 সপ্তাহ পর্যন্ত ব্যবহার করা যেতে পারে, কিন্তু বিভিন্ন মাত্রায় এবং regimens আবেদন, গর্ভাবস্থার সময়কাল এর  উপর নির্ভর করে। এই গর্ভপাত পদ্ধতির সুবিধা হলো এটি অস্ত্রোপচার পদ্ধতি এড়াতে সহায়তা করে। এটা একটা স্বতঃস্ফূর্ত এবং নিরাপদ। বিশেষ করে গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় তিনমাসের মধ্যে একটি ক্লিনিকাল সেটিং এ  এই পদ্ধতির ব্যবহার  নিরাপদ। আর এই গর্ভপাত পদ্বতির সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো , সম্পূর্ণ হবে গর্ভপাত হতে বেশ কয়েক ঘন্টা  থেকে   বেশ কয়েক দিন সময় লেগে যায়। গর্ভপাত এর পর   অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রথম 1-2 দিনের  মধ্যে রক্তপাত হতে পারে ,এমনকি এর পর কিছু দিন অথবা এমনকি কয়েক সপ্তাহ রক্তপাত হতে পারে । misoprostol এর কারনে  cramping হতে পারে  কারণ এটা জরায়ু কে  contract করে  তোলে, এটি বমি বমি ভাব এবং বমি হতে পারে। mifepristone + misoprostol এর সঠিক মাত্রার  সমন্বয়  96-98%  সম্পূর্ণ গর্ভপাত ঘটায়। ভ্যাকুয়াম অ্যাসপিরেশন: এই  পদ্ধতিতে জরায়ুর উদ্বাসন জড়িত ম্যানুয়ালি একটি হ্যান্ড হেল্ড প্লাস্টিক বাতশোষক (MVA) ব্যবহার দ্বারা বা একটি বৈদ্যুতিক ভ্যাকুয়াম পাম্প ব্যাবহার করা হয়। এই পদ্ধতিতে গর্ভাবস্থার 14 সপ্তাহের মধ্যে ব্যাবহার করা হয় যার সাফল্যের হার  95-100% শতাংশ। তবে এই পদ্ধতির সাফল্য গর্ভাবস্থার সময়কাল এর উপর নির্ভর করে।ভ্যাকুয়াম অ্যাসপিরেশন এর মাধ্যমে গর্ভপাত সম্পন্ন করতে 3 থেকে 10 মিনিট থেকে লাগে, এবং একটি স্থানীয় অবেদনিক ব্যবহার করে একটি বহির্বিভাগের রোগীদের ভিত্তিতে প্রাথমিক পর্যায়ে সম্পাদনা করা যেতে পারে। বেশীর ভাগ মহিলারাই  30 মিনিট পরে বাড়িতে যেতে সক্ষম  হন। ভ্যাকুয়াম অ্যাসপিরেশন গর্ভপাত ( সহজ অস্ত্রোপচার পদ্ধতি) এর  সুবিধা হলো  এটা সম্পন্ন করতে মাত্র কয়েক মিনিট সময় লাগে ।

৩. Dilatation and evacuation: এই পদ্ধতির জন্য প্রয়োজন দক্ষ, অভিজ্ঞ সেবা প্রদানকারী হেলথ সার্ভিস প্রভাইডার অথবা প্রতিষ্ঠান । এটি সাধারণত গর্ভাবস্থার ১৪ সপ্তাহ পরে দ্বিতীয় তিনমাসের মধ্যে ব্যবহার করা হয়। সাধারনত এনেস্থেসিয়ার প্রয়োজন হয়না এবং এটি প্রজনন স্বাস্থের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এই পদ্ধতি সঞ্চালন করতে সাধারণত   ৩০ মিনিট এর চেয়ে সময় লাগে না ।

নিরাপদ গর্ভপাত সবকিছু নির্বিশেষে প্রত্যেক মেয়ের জন্য একটি অধিকার। গর্ভপাত এর নামে  মৃত্যু, অক্ষমতা, শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি সম্পূর্ণরূপে অপ্রত্যাশিত।গর্ভপাত এর সাথে সম্পর্কিত সব তথ্য নিয়ে  খোলামেলা আলোচনা করতে হবে , এই প্রজন্ম এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে  সুস্থ মানসিক স্বাস্থ্যের  পৃষ্ঠপোষকতা করতে সহায়তা করতে হবে,কেননা অনিরাপদ গর্ভপাত শুধু শারীরিক ক্ষতিই করছেনা, বরং মানষিক স্বাস্থ্যকেও বিঘ্নিত করছে।আর তাই সরকারি ,বেসরকারী এবং সামাজিক প্রতিষ্টানের মুক্ত আলোচনা এবং কিছু সুযোগ সুবিধা সবার জন্য প্রযোজ্য করে দিলে ধনী-গরীব, বিবাহিত-অবিবাহিত নির্বিশেষে সবাই নিরাপদ গর্ভপাতের অধিকার পাবে।  আর সব সমস্যা সমাধানের জন্য সেক্স এডুকেশন কে পাঠ্যপুস্তকে নিয়ে আস্তে হবে যাতে করে সবাই বয়ঃসন্ধিকাল থেকেই নিজের ব্যাপারে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে জানতে পারে এবং সচেতন হতে পারে। তাছাড়া পরিবারকেও এগিয়ে আসতে হবে ,সন্তানের সুষ্ঠ মানষিক বিকাশের ক্ষ্রেত্রে তাদের সাথে সব ব্যাপারে খোলামেলা আলোচনা করতে হবে,যাতে করে তারা বাইরের পরিবেশ থেকে ভুল তথ্য না পেয়ে বসে।