সাধারনত একটি মানুষের আট থেকে চৌদ্দ বছর বয়সের মধ্যেই বয়সন্ধিকাল শুরু হয় । ছেলেদের ক্ষেত্রে সাধারনত নয় থেকে পনেরও বছর বয়সে শুরু হয়। এই সময়ে ছেলেদের শরীরে বিভিন্ন লৈঙ্গিক হরমোন (সেক্স হরমোন বা এডাল্ট হরমোন )তৈরী হয় ,যার কারনে অনেক শারীরিক পরিবর্তন আসে ।আর এই শারীরিক পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় মানষিক পরিবর্তনআসে। তাই মন মেজাজের পরিবর্তন (মুড সুইং) শুধু মেয়েদেরই হয় না ,বরং ছেলেদের ক্ষেত্রেও হয়ে থাকে।
বয়সন্ধিকালে ছেলেদের যে ধরনের শারীরিক পরিবর্তন হয় ,তার প্রধান কারন হলো টেস্টোস্টেরন (Testosterone) নামক লৈঙ্গিক হরমোন বা সেক্স হরমোন । এই সময়ে ছেলেদের শরীরে এই হরমোন তৈরী হয় এবং অনেক ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসে।
অনেক পরিবর্তনের মধ্যে যে তিনটি প্রধান পরিবর্তন সব ছেলেদের মধ্যে আসে ,সেগুলো হলো :
- ইরেকশন (Erections )
- নকটারনাল এমিশন বা স্বপ্ন দোষ (wet dream)
- টেস্টিকলস (testicles)
১) ইরেকশন (Erections ) :রক্ত প্রবাহ যখন পুরুষ প্রজননতন্ত্র ( মেইল রিপ্রডাক্টিভ সিস্টেম) থেকে পিনেসে প্রবাহিত হয়, তখন পিনেস শক্ত এবং আকারে বড় হয়ে যায় ।আর বয়সন্ধিকালে এটি খুবই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ,কারন সেক্স হরমোন তৈরীর কারনে অনেকেই তখন নিজের সেক্সুয়ালিটি অনুভব করে অথবা অনেক সময় কোনো কারন ছাড়াই পিনেস এরকম আকারে বৃদ্ধ্বি বা শক্ত ( ইরেক্টেড) হয়ে যায় ।
২) নকটারনাল এমিশন বা স্বপ্ন দোষ (wet dream) :
সব ছেলেদের সাথে ঘটে থাকে আর সেটকে বিজ্ঞানের ভাষায় নকটারনাল এমিশন বলে( nocturnal emission)। এর মানে হলোঅনেক সময় ঘুমের মধ্যে ইজাকুলেশন (Ejaculation) হতে পারে ।তার মানে হলো- সাদা কালারের তরল(Fluid) পেনিসের মধ্য দিয়ে বের হয়ে আসে এবং এই তরল তৈরী হয় সেমিলান ভেসিকল এবং প্রসটেট গ্ল্যান্ড এর মাধ্যমে, যা স্পার্মের (শুক্রানুর) সাথে মিশে সিমেন তৈরী করে। আর দুধের মত এই তরল (Milky fluid) এর বেরিয়ে আসাকেই ইজাকুলেশন বলে।আর এই পুরো প্রক্রিয়াকে ওয়েট ড্রিম বা স্বপ্ন দোষ বলে থাকে, যা ঘুমের মধ্যে হয়ে থাকে ।তাই ঘুম ভাংগার পর অনেকেই হয়তো খেয়াল করেন থাকেন সাদা রংয়ের তরল অথবা ভেজা অনুভব করেন ,আর এজন্যই একে ওয়েট ড্রিম বলে। এবংএটি খুবই স্বাভাবিক এবং বিজ্ঞানসম্মত একটি প্রক্রিয়া যাতে করে সিমেন বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে ,যেহেতু প্রতিনিয়ত টেস্টিকল এর বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এটি তৈরি হচ্ছে ।
”স্বপ্ন দোষ” কথাটা কিভাবে এসেছে অথবা কতটুকু সঠিক ,সেটা এখনও বিতর্কিত। তবে বিজ্ঞানের ভাষায় একে নকটারনাল এমিশন বলে থাকে । অনেক সময় ঘুমের মধ্যে শরীর থেকে সাদা রংয়ের তরল বেরিয়ে আসে ,অনেকের ঘুম ভেঙ্গে যায় অথবা অনেকে ঘুম থেকে উঠার পর বুঝতে পারে । এটা বেড়ে উঠার খুবই স্বাভাবিক একটা প্রক্রিয়া । ঘুমের মধ্যে এরকম তরল বেড়িয়ে আসা ইজাকুলেশন এর কারনে হয়ে থাকে এবং এটাই প্রমান করে যে একটা ছেলে বয়সঃন্ধিতে ঠিকঠাকমত বেড়ে ঊঠছে ।
এখন নিশ্চই তোমার মনে প্রশ্ন আসছে ? কেনো এই ওয়েট ড্রিম বা স্বপ্ন দোষের ব্যাপারটা ঘুমের মধ্যে আমাদের সাথে ঘটে থাকে ? বয়ঃসন্ধিতে আমাদের ছেলেদের শরীরে লৈঙ্গিক হরমোন তৈরী হতে থাকে যাকে টেস্টেস্টরন (Testosterone) বলে । এই হরমোন তৈরী হলেই ছেলেদের স্পার্ম/শুক্রানু তৈরী হওয়ার ক্ষমতা লাভ করে । আমরা সবাই জানি ,ছেলেদের শুক্রানু পরবর্তী জীবনে মেয়েদের ডিম্বানুর সাথে মিলিত হয়ে জাইগোট এবং ভ্রুন তৈরী করে ,যা থেকে একটা সন্তান জন্মগ্রহন করতে পারে ।আবার বয়সন্ধিতে ছেলেদের যে ইরেকশন হয়ে থাকে এবং হরমোন তৈরী হওয়ার কারনে ছেলেদের বডিতে যে সিমেন তৈরী হয়ে থাকে, সেই সিমেন বের হয়ে আসার একটা প্রক্রিয়া হলো ওয়েট ড্রিম বা স্বপ্ন দোষ।
৩)টেস্টিকলস (Testicles):
বয়সন্ধিতে একটা ছেলের টেসটিকল (testicles –testes or balls) আস্তে আস্তে পরিনত হতে থাকে ।তখন টেস্টিকল হরমোন তৈরী করা শুরু করে ,আর এই হরমোনদের মেইল হরমোন (Male Hormone ,example- testosterone) বলে ।এই হরমোনের কারনেই অনেক ধরনের শারীরিক এবং মানষিক পরিবর্তন আসে। আর ধীরে ধীরে একটা ছেলেএকটু একটু করে লম্বা হতে থাকে ,তার কন্ঠস্বর বদলে যেতে পারে ,শরীরের বিভিন্ন স্থানে লোম গজাতে থাকে ,মাংস পেশী বৃদ্ধি পেতে পারে , ব্রেস্টেরসাইজ বড় হতে পারে অথবা জেনিটাল এর অনেক পরিবর্তন হতে পারে ,আর সেইসব প্রজন ন অংগ প্রত্যঙ্গের আকার আকৃতির পরিবর্তন এবং এর কারনগুলোই একটা ছেলে বা মেয়েকে আলাদা করে । অবশ্যই আমাদের সবচেয়ে বড় পরিচয় আমরা মানুষ তবে কিছু শারীরিক এবং গঠনগত পার্থক্য একটা মানুষকে ছেলে অথবা মেয়ে হিসেবে আলাদা করে ।
এবার আসো একটু জেনে নিই টেস্টিকল /Testicles (testes) সম্পর্কে ।
পুরুষ প্রজনন তন্ত্রে এ সাধারনত দুটি টেস্টিস থাকে। এই দুটো টেস্টিস এর প্রধান কাজ হলো টেস্টোস্টেরন (testosterone) নামক প্রাথমিক লৈঙ্গিক হরমোন তৈরী হয় (primary male sex hormone) এবং শুক্রানু (স্পার্ম) তৈরী করা। টেস্টিস এর মধ্যে সেমিনিফেরাস টিউবিউলস (seminiferous tubules) থাকে েবং এই টিউবগুলিও শুক্রানু বা স্পার্ম তৈরী করে।
বয়ঃসন্ধিতে ছেলেদের টেস্টিকলে অনেক পরিবর্তন আসে ।টেস্টোস্টেরন নামক সেক্স হরমোন এর সহায়তায় টেস্টিকল স্পার্ম তৈরী করে। মাঝে মাঝে টেস্টিকল এর সাইজ যদি অস্বাভাবিক হয় অথবা কোনো কারনে ফুলে যায় ,তাহলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে ।তাই নিয়মিত নিজের বিভিন্ন প্রজনন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বা সেক্স অরগান নিজেই পরীক্ষা করার বিশেষ কিছু নিয়ম পরিবারেরও জানা উচিত এবং তাদের সন্তানকে জানানো উচিত কেননা পনেরো থেকে ত্রিশ বছর বয়সী ছেলেদের জেনিটাল ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি ।
এই তিনটি প্রধান পরিবর্তন ছাড়াও আরো অনেক ধরনের পরিবর্তন আসে ।এখন কথা বলবো সেগুলো নিয়ে।
- ভয়েস বক্স অথবা The larynx (‘Adam’s apple’ or voice box): বড় হয়ে উঠার এই সময়টাতে ভয়েস বক্স বা ল্যারিংস বড় হতে থাকে । আর তখনই কন্ঠস্বর ভাংতে অথবা বদলাতে শুরু করে।আর এভাবে আস্তে আস্তে একটা ছেলের কন্ঠস্বর ভাংতে ভাংতে পরিনত হতে থাকে ।আর এই পরিবর্তন খুবই স্বাভাবিক। আরও একটি গুরুত্ত্বপুর্ন শারীরিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় । আর সেটা হলো ফেসিয়াল হেয়ার ,যেমন দাড়ি বা গোফ। এছাড়াও আন্ডার আর্মস(বগল) এবং পিউবিকএড়িয়াতে বেশী লোম গজাতে দেখা যায় ।
- বয়সন্ধিতেপ্রায় এক তৃতীয়াংশ ছেলের ব্রেস্ট একটু বড় হতে পারে ,নিপল একটু ফুলে যেতে পারে এবং এটাই স্বাভাবিক ।
- আরএই সচরাচর পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় ভালো খাদ্যাভাস খুবই জরুরী ।এই যেমন প্রচুর পানি পান করতে হব্বে ,শাক–সবজি–মাছ–ফল মূলখেতে হবে ।
- এইসময়টাতে বাইরের খাবার এই যেমন ফাস্ট ফুড, তেলের ভাজা-পুড়া খুব বেশি একটা না খাওয়াই ভালো, কেননাএটা প্রজনন স্বাস্থ্যের জন্য একটু ক্ষতিকর।
- বয়সন্ধিকালেআমাদের শরীরকে হরমোন তৈরীর মেশিন বলা হয়ে থাকে ।আর এই সময়টাতেই নিত্যনতুন হরমোন তৈরীর কারনে বিভিন্ন গ্রন্থি ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে ।আর এর ফলে ব্রন এবং পিম্পলস হতে পারে ।আর বয়ঃসন্ধিতে প্রায় সব তরুন-তরুনীকেএই সমস্যায় পড়তে হয় ।
- আরও একটা সমস্যায় বয়ঃসন্ধিতে অনেকেই পড়ে থাকেন আর সেটা হলো ঘাম । অনেকেই আছে যারা অনেক বেশি ঘামতে থাকে এবং এটি খুবস্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া । দুর্গন্ধ হওয়ার প্রধান কারন হলো ব্যাক্টেরিয়া জন্মাতে থাকে ,আর তাই বেশি ঘাম দুর্গন্ধের কারন হতে পারে।
উপরের প্রত্যেকটা কারন এর সাথে বয়সঃন্ধিকালে প্রত্যেকটা ছেলেকেই পরিচিত হতে হয় । আর একটু একটু করে, একটা ছোট মানুষের একটা ছেলে হয়ে ওঠার পেছনের গল্পটা হলো হরমোনাল পরিবর্তন ,যার ফলে এসব পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় ।সর্বোপুরি ,একটা মানুষকে ছেলে অথবা মেয়ে হিসেবে আলাদা করার প্রধান হাতিয়ার হওয়া উচিত তার শারীরিক এবং মানষিক পরিবর্তনের বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা । সামাজিক কোনো বাধা অথবা কুসংস্কার যেনো ছেলে অথবা মেয়েকে আলাদা করার হাতিয়ার না হয়,সেজন্য নিজেকে জানার বা সেক্স এডুকেশন এর বিস্তারের কার্যক্রম পরিবার থেকেই শুরু হওয়া উচিত ।
Recent Comments